ঢাকা অফিস : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দলে ভরাডুবি, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূল নেতাকর্মীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও নেতাদের বহিষ্কারের ঘটনার জন্য দায়ী করে পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে দল থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ। নেতাকর্মীদের অনুরোধে কাউন্সিলের আগ পর্যন্ত তিনি দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এ ছাড়া, কাজী মো. মামুনুর রশিদকে মহাসচিবের দায়িত্ব দিয়েছেন।
রবিবার (২৮ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর গুলশানের বাসভবনে জাতীয় পার্টির বহিষ্কৃত, অব্যাহতিপ্রাপ্ত, স্বেচ্ছায় পদত্যাগকারী নেতাকর্মীসহ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এ ঘোষণা দেন।
রওশন জানান, জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের বিভিন্ন সময়ে যেসব নেতাদের বিভিন্ন পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি বা বহিষ্কার করেছেন, তাদের স্বপদে বহাল করা হবে। খুব শিগগির দলের দশম কাউন্সিল আয়োজন করা হবে।
লিখিত বক্তব্যে রওশন এরশাদ বলেন, দলের সংকট নিরসনে পার্টির নেতাকর্মীদের অনুরোধে এবং পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০/১ ধারায় বর্ণিত ক্ষমতাবলে আমি পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে জিএম কাদের ও মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নুকে অব্যাহতি প্রদান করলাম। নেতাকর্মীদের অনুরোধে আমি পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করলাম। পরবর্তী সম্মেলন না হওয়া পর্যন্ত আমি কাজী মো. মামুনুর রশিদকে মহাসচিবের দায়িত্ব প্রদান করলাম। তিনি সার্বিকভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
রওশন এরশাদের মতবিনিময় সভায় তার ছেলে সাদ এরশাদ, প্রফেসর দেলোয়ার হোসেন, অব্যাহতিপ্রাপ্ত প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, ভাইস চেয়ারম্যান আমানত হোসেন, ইয়াহিয়া চৌধুরী, কাজী মামুনুর রশীদ, জাপার সাবেক এমপি জিয়াউল হক মৃধা, গোলাম সারোয়ার মিলন, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাবেক উপদেষ্টা ও জাতীয় ছাত্রসমাজের প্রতিষ্ঠাতা রফিকুল হাফিজ, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম নুরুসহ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা নাটকীয়তার জন্ম দেয় জাপা। নির্বাচনে যাওয়া-না যাওয়ার প্রশ্নে সিদ্ধান্তহীনতা ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতার গোপন বৈঠকে দলের ভেতরে টানাপড়েন তৈরি করেন দলের শীর্ষ তিন নেতা। নির্বাচনের আগে সাংগঠনিক দুর্বলতা এতই প্রকট হয়ে পড়ে যে, ৩০০ আসনে যোগ্য প্রার্থী খুঁজে পায়নি দল। নির্বাচনের পরে এ কথা স্বীকার করে নিয়েছেন দলের মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু।
নির্বাচনের পর পার্টিতে ‘ক্রান্তিকাল বিরাজ করছে’ উল্লেখ করে রওশন এরশাদ বলেন, দ্বাদশ নির্বাচনের পূর্বে পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের বক্তব্য-বিবৃতি এবং দ্বাদশ নির্বাচন পরবর্তী সময়ে তাদের ভূমিকা পার্টিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। নিবার্চনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৭টিতে মনোনয়ন দিয়ে ২৬টি আসনে সমঝোতা করা, আসন সমঝোতার পরও জনসম্মুখে অস্বীকার করে দেশবাসী ও পার্টির মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে পার্টিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে।
এবারের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে যে ২৬টি আসনে সমঝোতা করেছিল, তা মধ্যে মাত্র ১১টিতে জয়লাভ করে। সমঝোতা হওয়া আসনগুলোর মধ্যে চার জন প্রার্থী জামানত হারান। সমঝোতা হওয়া আসনগুলোর বাইরে থাকা প্রার্থীরা বিপুল ভোটে হেরে জামানত হারান। সমঝোতার বাইরে থাকা আসনগুলোর প্রার্থীরা ভোটের মাঠে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখ করে রওশন বলেন, ২৬টি আসন সমঝোতার পর বাকি আসনের প্রার্থীদের রাজনৈতিকভাবে জনগণের বিরূপ সমলোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। চেয়ারম্যান ও মহাসচিব তাদের কোনও খোঁজখবর না নেওয়ার ফলে ভোটের মাঠে পার্টি চরমভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
নির্বাচনের পরে হেরে যাওয়া জাপা প্রার্থীদের বড় অংশ দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করেন। দলের ভরাডুবি, আর্থিক অনিয়মসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে গত ১০ জানুয়ারি রাজধানীর বনানীতে জাপা চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন নেতাকর্মীরা। জিএম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যর্থতার অভিযোগ এনে দুজনের পদত্যাগও দাবি করেন বিক্ষুব্ধরা।
এ সময় জিএম কাদের দলের কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভরায়কে বহিষ্কার করেন। পরে ১৪ জানুয়ারি ঢাকার কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন পার্টির বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। এরপরই দল থেকে প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু ও ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াহিয়া চৌধুরীসহ বেশ কজন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়।
গত ২৫ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি থেকে অব্যাহতি পাওয়া প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টুর নেতৃত্বে ঢাকা মহানগর উত্তর কমিটির ৭০০ নেতা দল থেকে পদত্যাগ করেন। এ সময় শফিকুল ইসলাম সেন্টুসহ নেতারা রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টিতে কাজ চালয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।