১৩ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩০শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Mirror Times BD

দেড় কোটি টাকা নিয়ে উধাও ম্যানেজার, হতাশায় ডুবেছেন ‘ব্যাংকের’ গ্রাহকরা

নীলফামারী প্রতিনিধি : আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স (এসিসিএফ) নামের কথিত ব্যাংকের গ্রাহকরা জমানো টাকা ফেরত না পেয়ে হতাশায় দিন পার করছেন। জমাকৃত আমানতের প্রায় দেড় কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে কথিত ওই ব্যাংকের ম্যানেজার জাহিদ শাহের বিরুদ্ধে।

জাহিদ জেলা সদরের ইটাখোলা ইউনিয়নের ফকিরপাড়া গ্রামের জাকির হোসেন শাহের ছেলে এবং এসিসিএফ ব্যাংকের ম্যানেজার।

নীলফামারী পৌর শহরের হাড়োয়া এলাকার বাসিন্দা ও ব্যাংকের গ্রাহক জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি একজন গরিব মানুষ। কুলি-মজুরের কাজ করে যে টাকা পেয়েছি পুরোটাই এসিসিএফ ব্যাংকে রেখেছি। এক মাস আগে টাকা তুলতে গিয়ে দেখি ব্যাংক বন্ধ। আশপাশের লোকের মুখে শুনতে পাই, আমার মতো অনেকেই টাকার জন্য ঘুরতেছে। আমি মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য ওই ব্যাংকে ৬০ হাজার টাকা জমা রেখেছিলাম। এখন আসলও নাই, লাভও নাই। গলায় ফাঁস দিয়ে মরা ছাড়া কোনও উপায় নাই। আমি এর বিচার চাই।’

সদরের ইটাখোলা ইউনিয়নের ইটাখোলা গ্রামের গ্রাহক মনছুর রহমান বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে এক লাখ ১০ হাজার টাকা ম্যানেজার জাহিদের কথামতো রেখেছিলাম। সে আমার পরিচিত হওয়ায় কিছু লাভের আশায় সরল বিশ্বাসে আমার কষ্টের টাকা তার কাছে রেখেছি। আমার ভিটেমাটি কিছুই নাই, পরের জমিতে কাজ করে খাই। অনেক কষ্ট করে ছেলে মেয়েদের না খাইয়ে তার কথামতো (এসিসিএফ) টাকাটা জমা রেখেছিলাম। টাকা না পেলে বাড়িতে আমি মুখ দেখাতে পারবো না। কারণ বাড়ির সবাই টাকা রাখতে মানা করেছিল। এখন তার ফল পাচ্ছি।’

জানা গেছে, কথিত এই ব্যাংকটি ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও মূল কার্যক্রম চালু হয় ২০১৮ সালে। জাহিদ ২০১৮ সাল থেকে ম্যানেজার হিসেবে ওই ব্যাংকে কর্মরত আছেন। ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালিত ব্যাংকটি জেলা শহরের কিচেন মার্কেট বড় বাজার এলাকার সাব্বির ভিলার দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত।

গ্রাহকরা জানান, ২০১৮ সালে জুলাই মাসে শহরের কিচেন মার্কেটস্থ এলাকায় ব্যাংকের কার্যক্রম চালু করেন আলতাফ হোসেনসহ জাহিদুজ্জামান। তিনি ছয় জন কর্মচারী নিয়ে প্রায় ছয় বছর যাবৎ ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। বর্তমানে এসিসিএফের গ্রাহকসংখ্যা প্রায় পাঁচ শতাধিক। ব্যাংকটি বাজারসংলগ্ন হওয়ায় বড় বড় ব্যবসায়ী, এবং স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ কৃষিশ্রমিকরাও তাদের পরিশ্রমের টাকা সেখানে জমা রাখতেন।

সদরের ইটাখোলা ইউনিয়নের আব্দুল মজিদের ছেলে গ্রাহক শামিম মিয়া বলেন, ‘আমরা তিন ভাই মিলে সাত লাখ ৫০ হাজার টাকা জমা রাখি। চুক্তি অনুযায়ী লাখে ১০০০ হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত লভ্যাংশ প্রতিমাসে দেওয়ার কথা। এখন লাভ তো দূরের কথা আসল টাকাই পাচ্ছি না। সেই টাকার জন্য ঘুরতে ঘুরতে একপর্যায়ে আজ দেবো কাল দেবো বলে সময় ক্ষেপণ করতে থাকেন। এসে দেখি ব্যাংক বন্ধ। এ ছাড়াও শওকত আলীর ৩ লাখ, ওয়াজেদ আলীর ৪ লাখ, সুরত আলী ৭ লাখ, আমিনুর রহমান ৩ লাখ, আরব আলী শাহ এক লাখ ৮০ হাজার, আব্দুল মজিদ সাড়ে ৫ লাখ, জহুরুল ইসলামের ৬০ হাজার টাকাসহ একাধিক গ্রাহকের টাকা নিয়ে জাহিদ এখন উধাও।’

কিচেন মার্কেটের ব্যবসায়ী মাসুদ আলম বলেন, ‘মেয়ের বিয়ের জন্য ওই শাখায় টাকা জমাতে থাকি। সেখানে আমার নামে এক লাখ ২৬ হাজার, মেয়ের নামে এক লাখ ৫০ হাজার, স্ত্রীর নামে এক লাখসহ মোট তিন লাখ ৭৬ হাজার টাকা জমা রাখি।’ ছল ছল চোখে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমাকে “কবর” দিয়েছে বাবা। মেয়েটার বিয়ে ভেঙে গেছে। এখন কোনও উপায় দেখছি না কী করবো। এদের আমি বিচার চাই।’

শুধু তাই নয়, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই শাখার একজন কর্মচারী জানান, বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে সাধারণ গ্রাহকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়ে ম্যানেজার নিজের কাজে রাখতেন। গ্রাহকরা এ বিষয়ে কিছুই জানতো না। এরপর ব্যাংকের কয়েকজন গ্রাহক সঞ্চয়ী হিসাব থেকে টাকা তুলতে এসে দেখেন তাদের অ্যাকাউন্টে টাকা নেই। এতে ম্যানেজারের প্রতারণার বিষয়টি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরে শতাধিক গ্রাহক টাকা ফেরত নিতে এসে দেখেন ব্যাংক বন্ধ।

কানিজ ফাতেমা নামের এক ভুক্তভোগী গ্রাহক বলেন, ‘নিজের ভবিষ্যতের জন্য ওই ব্যাংকে দুই লাখ টাকা রেখেছিলাম। গত পাঁচ আগস্টের আগে সাংসারিক প্রয়োজনে টাকা তুলতে গিয়ে দেখি গেটে তালা ঝুলছে। এই বিচার কাকে দেবো। আমারটা টাকা উদ্ধারের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অনুরোধ জানাই।’

এদিকে, টাকা লোপাটের বিষয়টি জানাজানির পর গত এক বছর থেকে গ্রাহকরা ব্যাংকে এসে টাকা ফেরতের দাবি জানালে ম্যানেজার আজ দেবো কাল দেবো বলে টালবাহানা শুরু করেন। কিন্তু গত ৫ আগস্ট থেকে ব্যাংকের সকল কার্যক্রম বন্ধ করে গা ঢাকা দিয়েছেন ম্যানেজার ও তার সহকর্মীরা।

এ ব্যাপারে জেলা সমবায় কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, কো-অপারেটিভ শব্দটি ব্যবহার করা হলে সেটি সমবায়ের মাধ্যমে নিবন্ধন করে একটি নির্দিষ্ট জেলায় শাখা চালাতে পারবে। যে জেলার জন্য নিবন্ধন শুধু সেই জেলায় কার্যক্রম চালাতে হবে। বাইরের কোনও জেলায় শাখা অফিস বসিয়ে ঋণদান কর্মসূচি চালানোর নিয়ম নেই।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার জানামতে নীলফামারীতে এ ধরনের ব্যাংকের কোনও নিবন্ধন বা রেজিস্ট্রেশন করা হয়নি। পুরোটাই আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে তারা ঋণদান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছিল। যা সমবায় আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। এমনকি “ব্যাংক” শব্দটিও তারা লিখতে পারবে না।’

এসিসিএফ ব্যাংক অফিসের বাসার মালিক সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘এক বছর ধরে অফিস ভাড়ার টাকা পাচ্ছি না। এমনকি ব্যাংকে ২ লাখ টাকাও রেখেছি সেটাও পাচ্ছি না। এখন অফিস ভাড়া ও আমানতের টাকা রেখে পথে বসতে হয়েছে। বর্তমানে তারা ফোনও ধরে না। অফিসে তালা দিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে আমার টাকাসহ সকল গ্রাহকের টাকা ফেরত পেতে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই।’

অভিযুক্ত ব্যাংকের ম্যানেজার জাহিদুজ্জামান শাহ ফকিরকে তার মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন দিলেও রিসিভ করেননি। তাই অভিযোগের বিষয়ে তার কোনও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

২০১৭ সালে এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স ব্যাংক লিমিটেড দেশে অনুমোদনহীন ১১০ শাখা খুলে অবৈধ কার্যক্রম করছে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও উল্লেখ করা হয়, অতিরিক্ত মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে চলতি, সঞ্চয়ী ও বিভিন্ন ধরনের স্থায়ী আমানত হিসেবে সংগ্রহ করছে এবং উচ্চহারে সুদ ঋণ দিচ্ছে। ওই প্রতিষ্ঠানটি লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোনও ব্যাংক নয়, তাই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে কোনও ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রম না করার জন্য সবাইকে সতর্ক করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘদিন থেকে আজিজ কো-অপারেটিভ ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। তাদের সমিতির নামের এই ব্যাংকিং কার্যক্রমে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ ব্যাংক। তাদের আশঙ্কা, এভাবে নিয়ম না মেনে গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করায় তারা প্রতারিত হতে পারেন। এমনকি গ্রাহকরা হারিয়ে ফেলতে পারেন তাদের মূলধন।

আইন অনুযায়ী সমবায় সমিতির নামের সঙ্গে ব্যাংক শব্দটি ব্যবহার করার সুযোগ নেই। কিন্তু আইনের তোয়াক্কা না করেই ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাচ্ছে আজিজ কো-অপারেটিভ নামের সংগঠনটি।

সমবায় সমিতির নিয়ম আইনে বলা হয়েছে, সমবায় সমিতিগুলো শুধু সদস্যদের চাঁদা গ্রহণ ও তাদের মাঝে তা বিতরণ করতে পারবে। আজিজ কো-অপারেটিভ নিয়ম ভেঙে ব্যাংকের মতোই সঞ্চয় গ্রহণ ও ঋণ বিতরণ করছে। সমবায় সমিতি হওয়ার পরেও ১১০টি শাখায় ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে আজিজ কো-অপারেটিভ।

⠀শেয়ার করুন

loader-image
Dinājpur, BD
ফেব্রু ১৩, ২০২৫
temperature icon 15°C
clear sky
Humidity 47 %
Pressure 1011 mb
Wind 5 mph
Wind Gust Wind Gust: 5 mph
Clouds Clouds: 0%
Visibility Visibility: 10 km
Sunrise Sunrise: 06:42
Sunset Sunset: 17:57

⠀আরও দেখুন

Scroll to Top