১৫ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১লা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Mirror Times BD

দিনাজপুর বোর্ডের অধীন চার বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী ফেল

স্টাফ রিপোর্টার : দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডের অধীনে এসএসসির প্রকাশিত ফলে চার বিদ্যালয়ের কেউ পাস করেনি। চারটি বিদ্যালয়ে পরীক্ষার্থী ২৭ জন। এ নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন ফলের পর কয়েকটি প্রশ্ন উঠেছে। যেমন, এত অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়ে বিদ্যালয়গুলো চলে কীভাবে। শিক্ষা বিভাগ কিসের ভিত্তিতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে। এমপিওভুক্ত হলো কীভাবে।

শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিযোগ আছে, প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো তদারকি করা হয় না। এ ধরনের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঠিকমতো পড়াশোনা হয় না।

চারটি বিদ্যালয় হলো গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ঘগোয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। এখান থেকে ১৪ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অকৃতকার্য হয়েছে। আরেকটি হলো কুড়িগ্রামের না‌গেশ্বরী উপ‌জেলার পূর্ব সুখাতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। এখানের পাঁচ শিক্ষার্থী মানবিক বিভাগ থেকে অংশ নিয়ে অকৃতকার্য হয়েছে। তৃতীয়টি নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। এখান থেকে দুজন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অকৃতকার্য হয়েছে। চতুর্থটি দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার চৌমহনী মডেল উচ্চ বিদ্যালয়। ছয় শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে সবাই অকৃতকার্য হয়েছে।

ঘগোয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯৪ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১০ বছর পর ২০০৪ সালে এমপিওভুক্ত হয়। প্রধান শিক্ষকসহ ১৬ জন শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। এর মধ্যে ১৩ শিক্ষক ও তিন জন কর্মচারী। গত বছর ১৬ শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে পাস করেছিল ১৩ জন। এবার ১৪ জন অংশ নিয়ে সবাই অকৃতকার্য হয়েছে।

এ নিয়ে হতাশ অভিভাবকরা। এজন্য ঠিকমতো ক্লাস না হওয়াসহ শিক্ষকদের অবহেলাকে দায়ী করেছেন। তারা বলছেন, বিদ্যালয় খোলা থাকলেও শিক্ষার্থীদের আসার তেমন একটা আগ্রহ নেই। এ ছাড়া শিক্ষকরা গল্প-গুজব করে সময় কাটিয়ে বাড়িতে চলে যান। ক্লাস নেওয়া হয় না। ক্লাস না হওয়ায় শিক্ষার্থীরাও আসে না।

সবাই অকৃতকার্য হওয়ার কারণ জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল হাকিম বলেন, ‘প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পাস করার কথা ছিল। কিন্তু কেন এমন ফল হলো, তা আমার বোধগম্য নয়। আমরা পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছি। ফলের জন্য বোর্ডে চ্যালেঞ্জের প্রক্রিয়া চলছে।’

ঠিকমতো ক্লাস না নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে আব্দুল হাকিম বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস হয়; এবারই সবাই ফেল করেছে। আগে কখনও এমন হয়নি।’

পাসের হার শূন্য দুঃখজনক উল্লেখ করে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রোকসানা বেগম বলেন, ‘ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে যে বিষয়ে ফেল করেছে, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের কারণ দর্শানোর জন্য প্রধান শিক্ষককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম ঠিকমতো তদারকি হয় কিনা জানতে চাইলে রোকসানা বেগম বলেন, ‘তদারকি হয়। পড়াশোনার মান দেখেই পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে শিক্ষা বিভাগ।’

পূর্ব সুখাতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদ্যালয়‌টি ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠার পর ২০১০ সালে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এমপিওভুক্ত হয়। ২০১২ সাল থেকে নবম-দশম শ্রেণির পাঠদান পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়। গত বছর এসএসসিতে সাত শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে পাঁচ জন পাস করেছিল। বর্তমানে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ২০৬ শিক্ষার্থীর বিপরীতে প্রধান শিক্ষকসহ আট শিক্ষক রয়েছেন। এবার পাঁচ শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে সবাই ফেল ক‌রে‌ছে।

এভাবে ফেল করার কারণ জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের ইসলাম শিক্ষা বিষয়ের সহকারী শিক্ষক আব্দুল ওহাব বলেন, ‘করোনার কারণে স্কুল বন্ধ এবং বাল্যবিবাহ হওয়ায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ফিরিয়ে আনতে বেগ পেতে হয়েছে। তারপরও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে যাতে এমনটি না হয়, সেজন্য আমরা সচেতন থাকবো।’

এত কম শিক্ষার্থী দিয়ে কীভাবে বিদ্যালয় চলছে জানতে চাইলে কুড়িগ্রাম জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শামছুল আলম বলেন, ‘এসব স্কুলের বেতন বন্ধ হওয়া দরকার। প্রধান শিক্ষকরা নিজেদের মতো করে প্রতিষ্ঠান চালান। করোনাকাল শেষ হওয়ার তিন বছর পর এসে করোনার দোহাই দেওয়া অযৌক্তিক।’

শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সরকারি অনুদানের জন্য আবেদন করলেও এখনও এমপিওভুক্ত হয়নি। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নামে প্রতিষ্ঠানটি হওয়ায় সরকারি করার জন্য ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের অনুমোদন পায়। যা প্রক্রিয়াধীন আছে। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রধানসহ ১২ জন শিক্ষক এবং তিন জন কর্মচারী রয়েছেন। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে এটি একাডেমিক স্বীকৃতি পায়। তবে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের অনুমতি থাকলেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা জানাতে পারেনি শিক্ষা অফিস। ১২ শিক্ষকের এই বিদ্যালয় থেকে মাত্র দুজন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অকৃতকার্য হয়েছে।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে ছাত্রীর সংখ্যা দুই শতাধিক। এর মধ্যে এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় দুজন। তবে সোমবার বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানের সব কক্ষ তালাবদ্ধ। খোলা হয়নি অফিসসহ শ্রেণিকক্ষের দরজা-জানালা। বিদ্যালয় সংলগ্ন মাঠ ফাঁকা। কোনও ছাত্রীকে দেখা যায়নি।

অকৃতকার্য হওয়া দুই ছাত্রী জানায়, স্যাররা বিদ্যালয়ে আসেন না। বিদ্যালয়ে বসার চেয়ার-টেবিল নেই। পরীক্ষার আগে ফরম পূরণ করে আমাদের জানানো হয়, এসএসসি পরীক্ষা দিতে হবে। একপ্রকার বাধ্য হয়ে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছি। আসলে পরীক্ষা দেওয়ার মতো আমাদের কোনও প্রস্তুতি ছিল না।

বিদ্যালয় এলাকার বাসিন্দা তমিজ উদ্দিন বলেন, ‘এখানে ঠিকমতো ক্লাস হয় না। শিক্ষার্থীদের কখনও আমার চোখে পড়েনি। তবে মাঝেমধ্যে কয়েকজন শিক্ষককে আসতে দেখি। মাসের বেশিরভাগ দিন বন্ধই থাকে। কারণ শিক্ষার্থী নেই বললেই চলে। আশপাশের ও আমাদের ছেলেমেয়েরা অন্য বিদ্যালয়ে পড়ে।’

সোমবার সকালে বিদ্যালয়ে গিয়ে প্রধান শিক্ষক আকতার হাবিব সরকারের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিয়ে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে বাড়িতে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।

তবে বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মজিবর রহমান বলেছেন, আমাদের বিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্লাসে ২৫০ জন শিক্ষার্থী আছে। এর মধ্যে দুজন এসএসসিতে অংশ নিলেও পাস করেনি।

জানতে চাইলে নীলফামারী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘বিদ্যালয়টি ননএমপিওভুক্ত হওয়ায় বেহাল দশায় ফেলেছে। এজন্য দায়ী পরিচালনা কমিটি ও শিক্ষকরা। বঙ্গবন্ধু পরিবারের নামে নামকরণ করে দায় সেরেছে। মোটেও কাজটি ঠিক করেনি। এক ধরনের অপরাধ করেছে। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সঙ্গে কথা বলে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে দিয়ে তদন্তের পর ব্যবস্থা নেবো।’

চৌমহনী মডেল উচ্চ বিদ্যালয়

বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে নিম্ন মাধ্যমিক হিসেবে স্থাপিত হয়। ২০২২ সালে
উচ্চ মাধ্যমিকে উন্নীত হয়, সেইসঙ্গে এমপিওভুক্ত হয়। এবারই প্রথম ছয় শিক্ষার্থী এসএসসিতে অংশ নেয়। যাদের সবাই ফেল করেছে। বিদ্যালয়ে আছেন সাত শিক্ষক। নিম্ন মাধ্যমিকের সেই শিক্ষকরাই উচ্চ মাধ্যমিকে ক্লাস নেন। এনটিআরসিএর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের আবেদন করলেও এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, গ্রামীণ পরিবেশে বিদ্যালয়ের অবস্থান। নেই সীমানাপ্রাচীর। মাঠের পাশে ফসলের ক্ষেত। টিনশেডের দুটি ঘরে চলে শিক্ষা কার্যক্রম। প্রচণ্ড গরমে পাঠদান ব্যাহত হয়।

বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফরিদা ইয়াসমিন জানায়, পড়াশোনা আগের চেয়ে ভালো হচ্ছে। আমাদের ক্লাসে ৪০ শিক্ষার্থী। তবে অনেকে বাইরে কাজ করে। এজন্য ঠিকমতো ক্লাসে আসে না।

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আবু সায়েম বলেন, ‘এ বছরই প্রথম এসএসসি দেওয়ার অনুমোদন পাই আমরা। তবে খারাপ ফল হওয়ায় মর্মাহত হয়েছি। কিন্তু আমরা জুনিয়র শিক্ষক। সিনিয়র শিক্ষকের অভাব রয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চল ও দরিদ্র এলাকা হওয়ায় শিক্ষার্থীরা মাঠে-ঘাটে কাজ করে সংসার চালায়। ফলে নিয়মিত ক্লাসে আসে না। আমাদের চেষ্টার কোনও ঘাটতি নেই। চেষ্টা করবো, শিক্ষার্থীরা যাতে ভবিষ্যতে ভালো ফল করে।’

প্রধান শিক্ষক বিলকিস বলেন, ‘বিদ্যালয়টি ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ২২ বছর ননএমপিও প্রতিষ্ঠান ছিল। এমপিওভুক্ত হওয়ার পর নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর অনুমোদন পাই। এবারই এসএসসির প্রথম ব্যাচ অংশ নিলো। আসলেও দুঃখজনক। শিক্ষক স্বল্পতায় সাফল্যের মুখ দেখতে পাইনি। সবাই মিলে চেষ্টা করবো, সামনের দিনগুলোতে যাতে ভালো ফল করাতে পারি।’

বিগত দিনে বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত কোনও উন্নয়ন হয়নি, নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক—এমনটি জানিয়েছেন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মজিবর রহমান। তিনি বলেন, ‘এলাকার শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাসে আসতে পারেনি। এজন্য এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত। শিক্ষক সংকট। এসব প্রতিবন্ধকতার মাঝেও এসএসসি পরীক্ষার প্রথমবার অংশ নিয়েছে শিক্ষার্থীরা। আগামীতে ভালো হবে।’

কিসের ভিত্তিতে এসব বিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি পেয়েছে, কীভাবে এমপিওভুক্ত হয়েছে জানতে চাইলে দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর স. ম. আব্দুস সামাদ আজাদ বলেন, ‘যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করেনি, সেগুলোর বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানানো হবে। তাদের ব্যাপারে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দেবে। নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবো। এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে কম শিক্ষার্থীর কারণে ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।’

⠀শেয়ার করুন

loader-image
Dinājpur, BD
জানু ১৫, ২০২৫
temperature icon 19°C
overcast clouds
Humidity 43 %
Pressure 1018 mb
Wind 5 mph
Wind Gust Wind Gust: 5 mph
Clouds Clouds: 90%
Visibility Visibility: 10 km
Sunrise Sunrise: 06:53
Sunset Sunset: 17:35

⠀আরও দেখুন

Scroll to Top