১৬ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২রা চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Mirror Times BD

বিশ্বের প্রাচীনতম ডেজার্ট ‘আশুর’, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইসলামের ইতিহাস

পুডিংয়ে সাধারণত ছোলা ও মটরশুঁটি ব্যবহার করা হয় না, তবে এগুলো কিন্তু বিশ্বের প্রাচীনতম এক ডেজার্ট বা শেষ পাতের মিষ্টি খাবারের মূল উপাদান। কারো কারো মতে, এটি বিশ্বের সবচেয়ে সুস্বাদু ডেজার্টগুলোর মধ্যে একটি।

ইস্তাম্বুলের কুরতুলুস পাড়ায় ‘গোরেমে’ নামে এক পুরনো মিষ্টির দোকান রয়েছে। দোকানটি ওভেন-বেকড পুডিং এবং চমৎকার দুগ্ধজাত ডেজার্টের জন্য বিখ্যাত ছিল। মানবজাতির প্রাচীনতম ডেজার্ট বা শেষ পাতের মিষ্টি খাবার হিসেবে যে পদটিকে মনে করা হয় সেই ‘আশুর’ এখানে পাওয়া যায়।

ইসলামী ঐতিহ্য অনুসারে, আশুরকে প্রায়শই ‘নূহের পুডিং’ বলা হয়।

মহাবন্যায় বেঁচে ফেরার পরে এবং আজকের তুরস্কের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের প্রান্তে আরারাত পর্বতে ভেসে আসার পর নবীর পরিবার বিভিন্ন উদযাপনে বিশেষ খাবার হিসাবে ‘আশুর’ প্রস্তুত করতো বলে জনশ্রুতি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই এক বাটি ডেজার্টে সাধারণত বহু ধরনের শস্য, ফল, বাদাম থাকে। এক কথায় তাদের রান্নাঘরে যা কিছু অবশিষ্ট থাকতো তা একত্রিত করে তৈরি করা হতো এই ডেজার্ট। নানা ধরনের উপকরণে তৈরি করা এই খাবারটি খেতে হালকা মিষ্টি, বেশ ভারি এবং কিছুটা ঝাল স্বাদের সাথে ফলের মিষ্টতাও এতে থাকে।

খাবারটি যখন গরম গরম প্রস্তুত করা হয় তখন আশুরের ঘনত্ব অনেকটা ছানার মতো হয়। যখন ঠান্ডা পরিবেশন করা হয় তখন এটি জমাট বেঁধে কাস্টার্ডের মতো ঘন হয়ে যায়।

বিশ্বের প্রাচীনতম ডেজার্ট হিসেবে এর যেমন আলাদা পরিচয় আছে, এর বাইরেও আনাতোলিয়া বা বর্তমান তুরস্ক জুড়ে আশুরের গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক তাৎপর্য রয়েছে।

আরবি ভাষায় আশুর মানে ‘১০’। আশুরা বলতে ইসলামিক হিজরি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস মহররমের ১০ম দিনকে বোঝায়। ঐ সপ্তাহে বাড়িতে মিষ্টি রান্না করা হয় এবং বন্ধুদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। যা ভালোবাসা ও প্রাচুর্য প্রসারের প্রতীক।

তুরস্কের খাদ্য বিষয়ক সাংবাদিক সেমরে টোরুন ফ্যাশন ম্যাগাজিন ‘ভোগ’ এবং ‘জিকিউ’র নিবন্ধে এসব তথ্য দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, আশুর সম্ভবত বিশ্বের ঐ অঞ্চলটির সবচেয়ে প্রতীকী খাবার।

সেমরে টোরুন ব্যাখ্যা করেন, মহররমের ১০ তারিখটি শিয়া মুসলমানদের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে- সেই সঙ্গে দিনটি তুরস্কের গ্রামীণ শিয়া গোষ্ঠী আলেভিস এবং শহুরে শিয়া গোষ্ঠী বেকতাশিদের জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এটি নবী মুহাম্মদের (সা.) নাতি হুসেইনের শাহাদাতের ঘটনার প্রতিনিধিত্ব করে। এটি ছিল এমন এক ঘটনা যা ইসলামে শিয়া-সুন্নি বিভক্তির জন্ম দিয়েছিল।

সেমরে টোরুন তার লেখায় তার প্রয়াত মাতামহের সংস্কৃতি ও রান্না সম্পর্কিত অভ্যাসগুলো তুলে ধরেছেন। কারণ তার মাতামহ ছিলেন শিয়া ঐতিহ্য দ্বারা প্রভাবিত এবং সুফি-অনুপ্রাণিত বেকতাশি সম্প্রদায়ের একজন আধ্যাত্মিক নেতা। এর কারণে তার রান্নার চর্চায় প্রাচীন প্রভাবগুলো ছিল।

বেকতাশিদের শিকড় আনাতোলিয়ায় হলেও তুর্কি প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ১৯২৫ সালে সুফি আদেশ নিষিদ্ধ করার পর তাদের সদর দফতর আলবেনিয়ায় চলে আসে। কারণ তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস আলেভিজমের কাছাকাছি, যা একটি স্বতন্ত্র, অ-সুন্নি ধর্ম। তুর্কি জনসংখ্যার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ আলেভিস হলেও তাদের ধর্মবিশ্বাস কিন্তু আইনত সরকার কর্তৃক স্বীকৃত নয়।

সেমরে টোরুন জানিয়েছেন, আনাতোলিয়ান রান্নার নানা ধরনের বৈশিষ্ট্য আশুর নামের এই খাবারটিতে প্রতিফলিত হয়। ছোলা এবং মটরশুঁটির মতো উপাদান খাবারটিতে স্বাদের ভারসাম্য আনে। রান্নাঘরে পড়ে থাকা খাবার কতটা গুরুত্ব বহন করে এবং এই খাবারে মটরশুঁটি, ডাল, শস্য এবং বীজ থাকায় খাবারটি কতটা পুষ্টিকর হয়ে ওঠে তার বড় উদাহরণ আশুর।

তুরস্ক এবং এর বাইরেও আশুরের অগণিত ধরন এবং রেসিপি রয়েছে যেখানে ভিন্ন ভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করা হয়। যারা নিরামিষভোজী, তাদের জন্য আশুর হলো পুষ্টিগুণে পূর্ণ একটি খাবার। একে শীতকালীন মিষ্টির আদর্শ উদাহরণও বলা যেতে পারে। কেননা এটি অন্যান্য মিষ্টি খাবারের চেয়ে স্বাস্থ্যকর।

ইস্তাম্বুলের বাহসেহির ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য ইতিহাস এবং প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক সুনা ক্যাগাপ্টে নিউ লাইনস ম্যাগাজিনে লেখা এক প্রবন্ধে বর্ণনা করেছেন, মরুভূমি অঞ্চলের এই খাবার ইউরোপের দেশ গ্রীস এবং আর্মেনিয়ার রসুইঘর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্য এবং পূর্ব ইউরোপ জুড়ে আশুরের বৈচিত্র্যময় রেসিপি পাওয়া যায়। যদিও শৈশবকালে তিনি যেখানে বড় হয়েছেন সেখানেই আজও আশুরের প্রকৃত স্বাদ খুঁজে পান। তিনি বড় হয়েছেন তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্ব মালাটিয়া নামের শহরে, যেখানে সুন্নি এবং আলেভিস উভয় সম্প্রদায়ই বসবাস করে।

অধ্যাপক সুনা ক্যাগাপ্টে লিখেছেন, যখন আমি সাত বছর বয়সের সাদাসিধা মেয় ছিলাম, তখন আমি ধরে নিয়েছিলাম যে এই পুডিংটা শুধুমাত্র আলেভিরা খায়। কিশোর বয়সে, আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে সুন্নিরাও এটি তৈরি করে।

আশুরের ঐতিহ্যের সঙ্গে তার এবং তার পরিবারের অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করতে গিয়ে সুনা ক্যাগাপ্টে বলেছিলেন, তার মা ন্যূনতম ৮টি উপকরণ দিয়ে খাবারটি তৈরি করতেন। সেগুলো হলো- গম, ছোলা, সাদা মটরশুঁটি, কিশমিশ, দারুচিনি, আখরোট, পানি ও চিনি। খাবারটি তিনি গরম গরম পরিবেশন করতেন। এই পদটির মাধ্যমে সুস্বাস্থ্য এবং সুসম্পর্ক ধরে রাখা হতো।

তিনি আরো বলেন, আশুর তৈরির ক্ষেত্রে আমার দুটি স্মৃতির কথা মনে পড়ে। প্রথমটি আমাকে এমন এক সময়ে নিয়ে যায় যেখানে আমি দারুচিনি/আখরোটের মিশ্রণে ভরা একটি ছোট্ট তামার বাটি ধরে মায়ের সাথে সাথে হাঁটছি এবং আমার মা বড় একটি তামার পাত্রে গরম গরম পুডিং নিয়ে আমাদের প্রতিবেশীদের দরজায় টোকা দিচ্ছেন। আমার মা প্রতিটি প্রতিবেশীর বাটিতে পুডিং ঢেলে দেওয়ার পরে, তার ওপর আমি দারুচিনি/আখরোটের মিশ্রণ ছড়িয়ে দিতাম। গ্রামের মানুষ এভাবেই খাবার ভাগ করে খেতো।

ইস্তাম্বুলের কুরতুলুশ পাড়ার ‘গোরেমে’ দোকানটি একটি দীর্ঘ সময়ের প্রতিষ্ঠান। এটি ঐতিহাসিকভাবে একটি গ্রিক পাড়া যেখানে গেলেই এক ধরনের জাতিগত বৈচিত্র্যের অনুভূতি পাওয়া যায়। কেন না এখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আর্মেনিয়ান, গ্রীক এবং ইহুদি জনসংখ্যা রয়েছে। আশুরের ওপরও এই সাংস্কৃতিক প্রভাব পড়েছে। বর্তমান দোকান মালিক ইলহান ইয়ালকিন বলেন, এই দোকানের আশুর রেসিপি, তার পিতামহের রেসিপি দ্বারা প্রভাবিত।

মূলত আর্মেনিয়ার একটি ঠান্ডা স্যুপের উপর ভিত্তি করে এই আশুর তৈরি করা হয়েছে। ফলে একে মূল আশুরের একটি বিকল্প বলা যেতে পারে। তার সংস্করণটি ছিল সহজ সরল, তবে এর মধ্যেও উপকরণের আধিক্য যথেষ্ট। যার মধ্যে রয়েছে শুকনো ডুমুর, শুকনো এপ্রিকট, কিশমিশ, ছোলা, সাদা মটরশুঁটি, ওট বেরি, লবণ, চালের মাড়, গুঁড়ো করা হ্যাজেলনাট এবং অল্প পরিমাণ হলুদ, যা একটি মনোরম হলুদ আভা দেয়।

এই আশুরে যে মিষ্টি স্বাদ পাওয়া তা পুরোটাই প্রাকৃতিক, কোনো চিনি মেশানো হয় না। এছাড়া এপ্রিকট খাবারটিতে আশ্চর্যজনক টক স্বাদ যুক্ত করতো। কেউ যদি আশুর খেতে চান তাহলে নিঃসন্দেহে তাদের জন্য এই মিষ্টির দোকানগুলোই উপযুক্ত জায়গা।

তুরস্কের খাদ্য বিষয়ক সাংবাদিক সেমরে টোরুন বলেন, কিছু রেস্তোরাঁ শুধুমাত্র মহররম মাসেই আশুর পরিবেশন করে, অন্য সময়ে তেমন চাহিদা নাও থাকতে পারে।

২০০০ সালে সুনা ক্যাগাপ্টের মা মারা যাওয়ার পর, তিনি আশুর বানানোর রেওয়াজ অব্যাহত রাখেন। গত দুই দশক ধরে তিনি প্রতি বছর মহররম মাসে এটি রান্না করেন। তবে এই দুই দশকে তিনি আশুরের নিজস্ব রেসিপি তৈরি করে ফেলেছেন। তিনি এতে বাদাম এবং ফল যোগ করতেন এবং এটি ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশন করতেন।

সুনা ক্যাগাপ্টে বলেন, আমি মনে করি যে যখন এটি ঠান্ডা করে খাওয়া হয়, তখন এতে থাকা গম ঘন হয়ে যায়। এতে স্বাদ আরও ভালো হয় এবং সমস্ত উপাদান একসাথে খুব ভালভাবে মিশে যায়। আমি প্রথমবার রান্না শুরু করার সময় তাজা নাশপাতি, আপেল, শুকনো ডুমুর এবং এপ্রিকটের টুকরো যোগ করেছিলাম। সেই সঙ্গে একদানা দারুচিনি, লবঙ্গ বা আস্ত খোসা ছাড়ানো বাদাম এবং ঝোলকে সাদা করার জন্য এক মুঠো চালও যোগ করেছিলাম।

তিনি আরো বলেন, আমি আমার মায়ের কাছ থেকে যে রেসিপিগুলো শিখেছি তা আমি আরো ভালো করার চেষ্টা করতাম। আমি মনে করি এই পরিবর্তন আমাকে তার সঙ্গে অন্য স্তরে যুক্ত করে, এই ভেবে যে তিনি হয়তো এই পরিবর্তনকে অনুমতি দিয়েছেন এবং তিনি তা খুব উপভোগ করছেন।

কয়েক বছর ধরে রেসিপি নিয়ে গবেষণা এবং খাবার রান্না করার পর, সুনা ক্যাগাপ্টে বেশ কিছু সন্তোষজনক এবং অর্থপূর্ণ সিদ্ধান্তে এসেছেন। সেগুলো হলো- আশুর এবং এর ভিন্ন ভিন্ন রূপ যেভাবে মিষ্টতা, মাধুর্য, স্মৃতি ও নতুন সূচনাকে প্রতীকীভাবে তুলে ধরে তা আমার খুব ভাল লাগে। আমি মনে করি খুব কম রেসিপিতে আশুরের স্বাদের মতো ক্ষমতা রয়েছে।

সূত্র: বিবিসি

⠀শেয়ার করুন

loader-image
Dinājpur, BD
মার্চ ১৬, ২০২৫
temperature icon 38°C
clear sky
Humidity 12 %
Pressure 1003 mb
Wind 20 mph
Wind Gust Wind Gust: 35 mph
Clouds Clouds: 1%
Visibility Visibility: 10 km
Sunrise Sunrise: 06:13
Sunset Sunset: 18:14

⠀আরও দেখুন

Scroll to Top