৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৫শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Mirror Times BD

কোটি টাকার গরু, ১৫ লাখের ছাগল এবং ‘ফুটানি’

আমীন আল রশীদ :

‘মরি হায়রে হায় দুঃখে পরাণ জ্বলে, হাজার টাকার বাগান খাইলো পাঁচ সিকার ছাগলে।’

বাস্তবতা হলো, এখন একটি ছাগলের দাম দিয়ে রাজশাহী অঞ্চলে অন্তত ১৫টি বাগান কেনা যায়। আমের মৌসুমে পাইকাররা আম কেনেন বাগান হিসেবে। অর্থাৎ এক বিঘা আয়তনের একটি বাগানের আম বিক্রি করে হয়তো এক লাখ টাকাও পাওয়া যায় না। কিন্তু গণমাধ্যমের খবর বলছে, এবার কোরবানির হাটে একটি ছাগল বিক্রি হয়েছে ১৫ লাখ টাকায়। তার মানে একটি ছাগলের দাম দিয়ে ভালো জাতের আম আছে, এরকম ১৫টি বাগান কেনা সম্ভব!

অর্থাৎ ‘পাঁচ সিকার ছাগল’ বলে তাকে আর তাচ্ছিল্য করার সুযোগ নেই। বরং কোরবানির পশুর হাটে ছাগল এখন ভিআইপি পণ্য। অবশ্য যারা এই ছাগল কেনেন, তারা আরও বড় ‘ভিআইপি’!

চলতি মাসের শুরুতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সাদিক এগ্রোর খামারে থাকা ১৮০ কেজি ওজনের একটি ছাগল নিয়ে হইচই পড়ে যায়। পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতার খাসিটির দাম হাঁকা হয় ১৫ লাখ টাকা। আলোচনার তুঙ্গে থাকায় একে দেখতে খামারে তৈরি হয় উপচেপড়া ভিড়। ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। পরে এটি ১৫ লাখ টাকাতেই কিনে নেন ধানমন্ডি এলাকার একজন ক্রেতা। (সমকাল, ০৫ জুন ২০২৪)।

তবে শুধু ছাগল নয়, সাদিক এগ্রো নামে এই প্রতিষ্ঠান এবার আলোচনায় আছে গরু নিয়েও। মাস দুয়েক আগে রাজধানীতে প্রাণিসম্পদ মেলায় তারা ‘কোটি টাকার একটি গরু’ এনে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় কথিত ‘বংশ মর্যাদাপূর্ণ’ কোটি টাকার সেই গরুও বিক্রি হয়ে গেছে। সাদিক এগ্রোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের খামারে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাহামা জাতের তিনটি গরু ছিল। যা বিক্রি হয়ে গেছে।

সারা বিশ্বেই গরুর নানা জাত আছে। কোনও কোনও বিশেষ জাতের গরু বেশ চড়া দামে বিক্রি হয়। প্রখ্যাত শেফ ড্যানিয়েল সি গোমেজ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘লিওনেল মেসি বা তার টিমের খেলোয়াড়রা যে গরুর মাংস খান, সেগুলোর কেজি বাংলাদেশি টাকায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা।’

সুতরাং বাংলাদেশের বাজারে যদি কোটি টাকা দামে কোনও গরু বিক্রি হয়, তাহলে সেটি নিয়ে অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে যে, সত্যিই সেটি কোন জাতের, তার ওজন কত, সেটি কোন প্রক্রিয়ায় বড় করা হয়েছে, কোথা থেকে কোন প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ করা হয়েছে, কত দাম দিয়ে কেনা হয়েছে এবং সেটি লালন-পালন করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ফার্মের কত টাকা খরচ হয়েছে। আর এসব বিবেচনায় গরুটির সর্বোচ্চ দাম কত হতে পারে?

মুশকিল হলো, এসব নিয়ে অনুসন্ধান খুব কঠিন। সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে লোকবল সংকট এবং তারা অন্যান্য কাজ নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত থাকেন যে, কোনও একটি গরু নিয়ে তারা গবেষণা করবেন— সেই সময় হয়তো তাদের নেই। অথবা এটিও যে গবেষণা ও অনুসন্ধানের বিষয়, তাও হয়তো তাদের মাথায় নেই।

প্রতি বছরই কোরবানির পশুর হাটে কিছু কিছু পশু আলোচনায় আসে মূলত দামের কারণে। যেমন একসময় ২ লাখ টাকা দামের গরু বাজারে উঠলেই হৈচৈ পড়ে যেত। কিন্তু এখন ২ লাখ টাকা দামের গরু খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এটি সংবাদ বা সোশ্যাল মিডিয়ার বিষয় নয়। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, এখন ২০ লাখ টাকার নিচে কোনও গরুর দাম হলে সেটি নিয়ে সংবাদ হয় না। সোশ্যাল মিডিয়ায়ও সেটি ভাইরাল হয় না। মানুষ যেমন ভাইরাল হয়, তেমনি কোরবানির সময় পশুও ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত হয়। সমাজ ও রাষ্ট্র বোঝার জন্য এগুলো খুব বড় ইঙ্গিত।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, যত ভালো জাতের এবং যত বড় সাইজেরই হোক না কেন, একটি ছাগলের দাম ১৫ লাখ টাকা কী করে হয়? তার চেয়ে বড় কথা ছাগলটি অবিক্রিত থাকেনি। বিক্রি হয়ে গেছে। প্রশ্ন হলো যিনি কিনেছেন, তার উদ্দেশ্য কি স্রষ্টার উদ্দেশ্যে কোরবানি করা নাকি তিনি যে ১৫ লাখ টাকা দামের ছাগল কিনলেন বা কিনতে পারলেন সেটি জানানো? অর্থাৎ নিজের আর্থিক সক্ষমতার জানান দেওয়া।

কোটি টাকা দিয়ে একটি গরু কিংবা ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ছাগল কেনার সক্ষমতা এখন দেশের অনেক মানুষেরই আছে। কিন্তু যে প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই সেটি হলো, যারা কোটি টাকা দিয়ে গরু কেনেন, তাদের টাকার উৎস কী? অবৈধ পথে উপার্জিত টাকা দিয়ে পশু কোরবানি দিলে সেটি কি স্রষ্টার কাছে কবুল হবে? তারা কি কবুলের উদ্দেশ্যে কোরবানি দেন নাকি মাংস খাওয়া এবং ফুটানি করার জন্য?

এটা ঠিক যে, বৈধ পথে টাকা উপার্জন করেও অনেক লোক ধনী হয়েছেন। প্রশ্ন হলো, তারা কি এই ধরনের ফুটানি করেন? বলা হয়, যারা প্রকৃতই ধনী, তারা সমাজে টাকার গরম দেখান না। নিজের সম্পদ নিয়ে বাহাদুরি করেন না। তারা গোপনে প্রচুর অভাবী ও অসহায় মানুষকে সহায়তা করেন। বিশ-তিরিশ লাখ টাকা দিয়ে গরু কিনলেও সেটা নিয়ে ফুটানি দেখান না। কিন্তু যারা নব্য ধনী, যারা নানারকম অবৈধ কাজ-কর্মের মাধ্যমে বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন, তাদের শরীরে টাকার উত্তেজনা তৈরি হয়— যেটি তারা নানাভাবে ছড়িয়ে দিতে চান। তাদের মধ্যে প্রদর্শনকামিতা তীব্র হয়। এই ধরনের ফুটানির মধ্য দিয়ে তারা সমাজে নিজেদেরকে ক্ষমতাবান হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করেন। পশুর যেমন দাম অনেক, তেমনি তারাও নিজেদের ‘দামি’ হিসেবে প্রমাণ করতে চান—যার পেছনে কোরবানির যে প্রকৃত উদ্দেশ্য, অর্থাৎ স্রষ্টার জন্য প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করা— সেই দর্শনের সঙ্গে এইসব প্রদর্শনবাদিতা ও ফুটানির কোনও সম্পর্ক নেই।

বরং এই ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে কোরবানির পশুর হাটে একধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়। গরু ছাগলও সোনা ও হিরার মতো অতি মূল্যবান পণ্যে পরিণত হয়। হয়েছেও। এখন এক ভরি স্বর্ণের দাম (এক লাখ ২০ হাজার টাকা) দিয়ে একটা মাঝারি আকারের গরুও পাওয়া যায় না।

তার পেছনে একটি বড় কারণ গোখাদ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। ফলে প্রান্তিক চাষীদের পক্ষেও এখন গবাদী পশু লালন-পালন করে টিকে থাকা কঠিন। আর এই সুযোগটা নিয়েছে বড় বড় এগ্রো কোম্পানিগুলো। যাদের টাকার অভাব নেই। কোটি কোটি কিংবা শত কোটি টাকা খরচ করে তারা একেকটি ফার্ম গড়ে তুলছে এবং সেখানে তারা যেমন প্রচুর পয়সা খরচ করে গবাদী পশু লালন-পালন করছে, সেভাবেই লাখ লাখ টাকায় বিক্রি করছে। অর্থাৎ তারা তাদের ব্যবসাটি করে নিতে পারলেও মাঝখান থেকে বিরাট সংখ্যক মানুষের জন্য কোরবানির পশু কেনা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে গেছে। এ বছর এমন অনেকে পরিচিত লোকই কোরবানি দিচ্ছেন বা বা দিতে পারছেন না বলে জানালেন, যারা গত বছর বা তার আগের বছরও কোরবানি দিয়েছেন। অতএব যখন কোটি টাকায় গরু আর ১৫ লাখে ছাগল বিক্রি হচ্ছে তথা কেউ না কেউ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন— তখন মোটামুটি সচ্ছল হিসেবে পরিচিত আমাদের আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও পরিচিতজনদের মধ্যেও খোঁজ নিয়ে দেখা দরকার, গবাদী পশুর অস্বাভাবিক দামের কারণে কত মানুষ এবার কোরবানি দিতে পারছেন না।

ইসলাম ধর্মে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ কী এবং এটি কীভাবে এলো— সেই ইতিহাস সবার জানা। কোরবানির ঈদে পশু জবাইয়ের মধ্য দিয়ে প্রধানত দুটি উদ্দেশ্য হাসিল করা হয়; ১. মানুষের সবচেয়ে ‘প্রিয় জিনিস’ যে অর্থ বা টাকা, সেটি স্রষ্টার জন্য উৎসর্গ করার মধ্য দিয়ে তার আনুগত্য প্রকাশ এবং ২. আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে যে মানুষেরা সারা বছর ভালো খাবার খেতে পারেন না, সেই গরিব মানুষদের মধ্যে মাংস বিতরণ করা। এর বাইরে আরেকটি উদ্দেশ্য হলো সামাজিক। অর্থাৎ এরকম একটি ধর্মীয় বিধান যেটি এখন ধর্মীয় উৎসবও বটে, সেটি উপলক্ষ্য করে মানুষে মানুষে মেলবন্ধন ও যোগাযোগ দৃঢ় হয়। কিন্তু স্যাক্রিফাইস, কোরবানি বা ত্যাগের যে ধর্মীয় এমনকি যে সামাজিক বিধান, সেটি কোনও অর্থেই লাখ টাকার ছাগল কেনা কিংবা কোটি টাকায় গরু কেনার ফুটানি এবং মাংস খাওয়ার উৎসব নয়।

পশু জবাই কোরবানির ঈদের প্রধান অনুষঙ্গ হলেও তার অর্থ এই নয় যে, সেই পশু কিনতে গিয়ে পয়সাওয়ালা মানুষেরা প্রতিযোগিতায় নামবেন। কোরবানির ঈদ তাদের আর্থিক সক্ষমতা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনের উপলক্ষ্য নয়। তেমনি কোরবানির ঈদ মাংস খাওয়ারও উৎসব নয়। প্রশ্ন হলো, কোরবানির ঈদ কেন এবং কীভাবে আর্থিক সক্ষমতা প্রদর্শনের ফুটানি এবং মাংস খাওয়ার উৎসবে পরিণত হলো?

একসময় কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের গ্রাম ও ছোট শহরেও যেটি খুব সাধারণ চিত্র ছিল, সেটি হচ্ছে কিছু মানুষ নিজেদের কৃষি ও অন্যান্য কারণে গরু-ছাগল লালন পালন করতেন; সেখান থেকে প্রতি কোরবানিতে একটি পশু কোরবানি করতেন। প্রয়োজনে স্থানীয় হাটে দুয়েকটা বিক্রি করতেন। সেখানে গরু ছাগলের দাম নিয়ে এত ক্রেজ ছিল না। কারণ গরু ছাগল তখন পর্যন্ত ‘ভিআইপি পণ্যে’ পরিণত হয়নি। গরু ছাগল তখন পর্যন্ত গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রলের বিষয় হয়নি। এর একটি বড় কারণ তখন পর্যন্ত দেশে বড় বড় এগ্রো ফার্ম গড়ে ওঠেনি। গবাদি পশুর ব্যবসাটি তখন পর্যন্ত এইসব ফার্ম ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের দখলে চলে যায়নি। ফলে এখন ছোট ছোট খামারি কিংবা প্রান্তিক চাষীদের কাছেও কম দামে গরু ছাগল পাওয়া যায় না।

বাজারের উত্তাপ এসে লেগেছে গ্রামেও। অতএব বৈধ-অবৈধ নানা উপায়ে ধনী হওয়ার কিছু লোকের ফুটানির উৎসবে পরিণত হতে হতে নিম্নবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্তের জীবন থেকেও কোরবানির মতো একটি বড় ধর্মীয় আয়োজন হারিয়ে যায় কি না—সেটিই এখন চিন্তার বিষয়।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন। 

(প্রকাশিত লেখাটির মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে কোন আইনগত ও অন্য কোন ধরনের দায়-ভার মিরর টাইমস্ বিডি বহন করবে না)।

⠀শেয়ার করুন

loader-image
Dinājpur, BD
ফেব্রু ৮, ২০২৫
temperature icon 19°C
clear sky
Humidity 28 %
Pressure 1014 mb
Wind 5 mph
Wind Gust Wind Gust: 5 mph
Clouds Clouds: 1%
Visibility Visibility: 10 km
Sunrise Sunrise: 06:45
Sunset Sunset: 17:53

⠀আরও দেখুন

Scroll to Top