২০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৭ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
Mirror Times BD

বৈশাখের রঙে রাঙা হোক আগামীর স্বপ্ন

ড. মতিউর রহমান : পহেলা বৈশাখ, বাঙালির জীবনে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন। এটি কেবল একটি উৎসবের দিন নয়, বরং আবহমান কালের বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি, যা আমাদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি আর আত্মপরিচয়ের গভীরতম প্রদেশে প্রোথিত। ১৪৩২ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখ যখন আমাদের দ্বারে সমাগত, তখন প্রকৃতির মতোই আমাদের মনেও এক নতুন স্পন্দন অনুভূত হয়। পুরোনো দিনের জীর্ণতা ঝেড়ে ফেলে নতুন করে জীবন শুরুর প্রেরণা জাগে। আর এই নবজাগরণের রঙ যেন রাঙিয়ে দেয় আমাদের আগামীর স্বপ্নগুলোকে।

বৈশাখ মাস প্রকৃতির পালাবদলের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। রুক্ষ গ্রীষ্মের দাবদাহের পর প্রকৃতি যেন নবযৌবন লাভ করে। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া আর জারুলের রক্তিম আভায় ভরে ওঠে চারপাশ। আমের মুকুলের মিষ্টি ঘ্রাণ আর পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয় বাংলার আকাশ-বাতাস। এই সময়ে প্রকৃতি যেমন তার পুরোনো খোলস ছেড়ে নতুন রূপে সেজে ওঠে, তেমনি পহেলা বৈশাখ বাঙালির জীবনে নিয়ে আসে নতুন আশা আর সম্ভাবনার বার্তা। পুরোনো বছরের সকল গ্লানি, ব্যর্থতা আর মলিনতাকে পেছনে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবনকে আলিঙ্গন করার আহ্বান জানায় এই উৎসব।

পহেলা বৈশাখের উদ্‌যাপন বাঙালির ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির এক বর্ণিল চিত্রপট। এই দিনে বাঙালি জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একাত্ম হয়। গ্রামীণ মেলা থেকে শুরু করে শহরের রাজপথ পর্যন্ত সবখানেই দেখা যায় উৎসবের আমেজ। বৈশাখী মেলায় নাগরদোলা, পুতুলনাচ, লোকগান আর মুখরোচক খাবারের সমাহার যেন বাঙালির লোকায়ত জীবন ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। হালখাতা উৎসবের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা নতুন করে হিসাবের খাতা খোলেন, যা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন করে পথচলার ইঙ্গিত দেয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখের এক অত্যাবশ্যকীয় অংশে পরিণত হয়েছে, যা শান্তি, সমৃদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক হিসেবে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। এই শোভাযাত্রায় বাংলার লোকশিল্প, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের নানা উপাদান তুলে ধরা হয়, যা আমাদের শেকড়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

পান্তা-ইলিশ পহেলা বৈশাখের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও এর উৎপত্তি নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে, তবুও এই ঐতিহ্যটি বাঙালির রসনা তৃপ্তির পাশাপাশি উৎসবের আমেজকে আরও বাড়িয়ে তোলে। বিভিন্ন ধরনের লোকনৃত্য ও গান এই দিনের আনন্দকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আলপনার রঙে রাঙানো হয় বাড়ির আঙিনা থেকে শুরু করে শহরের পথঘাট পর্যন্ত, যা শিল্প আর সৃজনশীলতার এক নান্দনিক প্রকাশ। এই সকল ঐতিহ্য শুধু আনন্দদানের মাধ্যম নয়, বরং এগুলি বাঙালির জীবনযাত্রা, মূল্যবোধ আর প্রকৃতির সাথে সম্পর্কের প্রতিচ্ছবি।

১৪৩২ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখ আমাদের সামনে উন্মোচন করে এক নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত। নতুন বছর মানেই নতুন করে স্বপ্ন দেখার, নতুন করে পথ চলার প্রেরণা। আমাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা উন্নতির আশা রাখি। সামাজিক সম্প্রীতি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আর সাংস্কৃতিক বিকাশের স্বপ্ন দেখি আমরা। পহেলা বৈশাখ আমাদের সেই স্বপ্নগুলোকে আরও একবার উস্কে দেয়। আমরা কামনা করি একটি এমন সমাজের, যেখানে হানাহানি, বিদ্বেষ আর বৈষম্য থাকবে না, যেখানে সকলে মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করবে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা চাই এমন একটি পরিবেশ, যেখানে সকলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং দেশের উন্নতিতে সকলে অংশীদার হতে পারবে। আর সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা চাই আমাদের ঐতিহ্য আরও সমৃদ্ধ হোক এবং বিশ্ব দরবারে আরও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হোক।

প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা পহেলা বৈশাখের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। বৈশাখ মাস আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য আর এর গুরুত্বের কথা। গ্রীষ্মের রুক্ষতা শেষে বৃষ্টির আগমন যেমন প্রকৃতিকে সজীব করে তোলে, তেমনি আমাদের জীবনেও নতুন আশার সঞ্চার করে। পরিবেশ রক্ষার অঙ্গীকার এই দিনে আরও জোরালো হওয়া উচিত। আমরা যেন প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ ও সুন্দর পৃথিবী রেখে যাই – এটাই হোক আমাদের লক্ষ্য।

ডিজিটাল যুগে পহেলা বৈশাখের উদ্‌যাপন এক নতুন মাত্রা লাভ করেছে। প্রযুক্তির কল্যাণে আজ আমরা বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে বসেই এই উৎসবের আনন্দ উপভোগ করতে পারি। ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে বৈশাখী মেলা, অনলাইন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে পহেলা বৈশাখ আজ বিশ্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। এই নতুন সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে আরও ব্যাপক পরিসরে ছড়িয়ে দিতে পারি এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সাথে একাত্মতা স্থাপন করতে পারি।

পহেলা বৈশাখ শুধু একটি দিন নয়, এটি বাঙালির ঐক্য ও সংহতির প্রতীক। এই দিনে আমরা ভুলে যাই আমাদের ভেদাভেদ, আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ। সকলে মিলেমিশে আমরা উদ্‌যাপন করি আমাদের বাঙালি সত্তাকে। এই ঐক্যবদ্ধ চেতনা আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক বড় শক্তি যোগাতে পারে। যেকোনো প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে এই ঐক্য অপরিহার্য।

নতুন প্রজন্মকে তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত করার ক্ষেত্রে পহেলা বৈশাখের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজকের শিশুরা হয়তো শহুরে যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে, কিন্তু পহেলা বৈশাখের আনন্দমুখর পরিবেশ তাদেরকে তাদের শেকড়ের সন্ধান দেয়। বৈশাখী মেলা, মঙ্গল শোভাযাত্রা এবং অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা বাঙালি সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানতে পারে এবং এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখে। এভাবেই আমাদের সংস্কৃতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে টিকে থাকে।

বিশ্বের কাছে বাঙালি সংস্কৃতিকে তুলে ধরার এক অনন্য সুযোগ এনে দেয় পহেলা বৈশাখ। মঙ্গল শোভাযাত্রা আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ, যা আমাদের শিল্পকলা, সংস্কৃতি আর অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছে। অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী উদ্‌যাপনও আমাদের সংস্কৃতিকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করার মাধ্যম হতে পারে। এর মাধ্যমে আমরা বিশ্ববাসীকে আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য সম্পর্কে জানাতে পারি এবং একটি সহনশীল ও বহুত্ববাদী সমাজের বার্তা দিতে পারি।

১৪৩২ সালের পহেলা বৈশাখ আমাদের জীবনে নতুন করে স্বপ্ন বোনার দিন। বৈশাখের এই রঙিন পরিবেশে আমরা আমাদের আগামীর স্বপ্নগুলোকে আরও উজ্জ্বল করে তুলি। আমরা একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, যেখানে প্রতিটি মানুষ তার পূর্ণ সম্ভাবনা বিকাশের সুযোগ পাবে। বৈশাখের এই নবজাগরণের রঙ যেন আমাদের সেই স্বপ্নগুলোকে সত্যি করে তোলে। পুরোনো দিনের মলিনতা আর ব্যর্থতাকে পেছনে ফেলে আমরা নতুন উদ্যমে সামনের দিকে এগিয়ে যাই, বৈশাখের রঙে রাঙিয়ে তুলি আমাদের আগামীর প্রতিটি দিন। এই হোক ১৪৩২-এর পহেলা বৈশাখের অঙ্গীকার, এই হোক আমাদের সম্মিলিত স্বপ্ন।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

(প্রকাশিত লেখাটির মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে কোন আইনগত ও অন্য কোন ধরনের দায়-ভার মিরর টাইমস্ বিডি বহন করবে না)।

⠀শেয়ার করুন

loader-image
Dinājpur, BD
এপ্রি ২০, ২০২৫
temperature icon 27°C
few clouds
Humidity 66 %
Pressure 1006 mb
Wind 5 mph
Wind Gust Wind Gust: 6 mph
Clouds Clouds: 19%
Visibility Visibility: 10 km
Sunrise Sunrise: 05:38
Sunset Sunset: 18:30

⠀আরও দেখুন

Scroll to Top