১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৬শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Mirror Times BD

কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা ক্লাসমুখী হোক

মোস্তফা হোসেইন : কোটাবিরোধী আন্দোলন মোটামুটি গোটা দেশকে আন্দোলিত করেছে। এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের কষ্ট, পেশাজীবীদের দুর্ভোগও বেড়েছে। এটা যেকোনও আন্দোলনেরই স্বাভাবিক প্রকৃতি। এই দুর্ভোগজনিত কারণে আন্দোলনের বিষয় নিয়ে যেমন গণআলোচনা হয় তেমনি আন্দোলনকারীদের সমালোচনাও হয়ে থাকে। বাসের যাত্রী থেকে চায়ের দোকানের আড্ডায় আন্দোলন কতটা জায়গা পায় তা দিয়েও আন্দোলনের গতি-প্রকৃতির অনুমান পাওয়া যায়। চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলনও তার ব্যতিক্রম নয়।

কোটা বাতিলের দাবি যৌক্তিক কিংবা অযৌক্তিক ওই প্রশ্নে না গিয়ে এই আন্দোলনের প্রকৃতি, উদ্দেশ্য ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। বৈধতা নিয়ে যারা প্রশ্ন করেন, তাদের মধ্যে আবার একটি গ্রুপ আছে, যারা আন্দোলনকারীদের দাবিকে যৌক্তিক হিসেবে বলে থাকেন। মনে হতেই পারে দ্বিচারিতা যেন। এখানে ব্যক্তি ত্যাগ এবং নিজের পাওয়া না পাওয়ার বিষয়টি যেমন জড়িত, তেমনি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটও বিবেচ্য। যৌক্তিকতা নিয়ে যারা প্রশ্ন করেন তাদের কথা, আন্দোলনকারীদের দাবি ২০১৮ সালে যে প্রজ্ঞাপন মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করা হয়েছে, তাকে বহাল করতে হবে। প্রশ্ন আসতে পারে আন্দোলনকারীদের এই দাবির সঙ্গে সরকারের অবস্থান কী? সরকার কি তাদের আগের প্রজ্ঞাপন বাতিল অর্থাৎ সরকার কি আবারও মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল করেছে? বাস্তবতা হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করেছে এই সরকারই। এখনও সেই অবস্থানেই আছে সরকার।

সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা চেয়ে উচ্চ আদালতে মামলা হওয়ার পর সরকার নিজ অবস্থানকে ধরে রাখার জন্য আদালতে লড়াই করেছে। সেটাও কোটা বাতিলের পক্ষেই। কিন্তু আদালতে সরকার হেরে যায়। ফলে আদালতের রায় অনুযায়ী আবার মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালু হওয়ার কথা। কিন্তু সরকার মনে করেছে, তারা আদালত থেকে সুবিচার পায়নি। এবং আপিলের মাধ্যমে তারা ঠিকই তাদের পক্ষে রায় পাবে। সেই রায় পেতে হলে সরকারকে আপিল করতে হবে। যতটুকু জানা যায়, সরকারি সিদ্ধান্ত বহালের জন্য তারা আপিল করতেও প্রস্তুত। এবং হাইকোর্টের রায়ের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পাওয়ার অপেক্ষা করছে তারা। তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়ালো, সরকার মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করেছে, সরকার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতেও যাবে এটাও অ্যাটর্নি জেনারেলের দাবি। তাতে স্পষ্ট হয়ে যায়, আন্দোলনকারীরা যে দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে সেই দাবির সঙ্গে সরকারের ভিন্নতা নেই। তাহলে আন্দোলনটা কার বিরুদ্ধে?

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আন্দোলনকে আদালত অবমাননা বলে ইতোমধ্যে দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি ও সমমনা কয়েকটি দল সমর্থন দেওয়ার কারণে বিষয়টি রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপলাভ করেছে। এই মুহূর্তে তাই কোটাবিরোধী আন্দোলন আর শুধু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নেই, এটা রাজনৈতিক আকার ধারণ করেছে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও স্পষ্ট বলেছেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনে রাজনীতি এসে ভর করেছে। হতেই পারে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি আন্দোলনকে কাজে লাগাতে চায় কিংবা সফলও হয় তাতেও অস্বাভাবিকতা মনে হওয়ার কারণ নেই।

আন্দোলনকারীদের দাবি হচ্ছে, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত কোটা বাতিল করতে হবে। ঘুরিয়ে বলতে গেলে বর্তমান কোটা নীতির পরিবর্তন করতে হবে। এক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটার সমালোচনাকারীদের বক্তব্য হচ্ছে– মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ সব মিলিয়ে কোটা ৫৬%, যা বৈষম্যমূলক। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০% কোটা বরাদ্দ নিয়ে কারও আপত্তি নেই। কিন্তু বিষয়টি যখন তাদের নাতি-নাতনি পর্যন্ত গিয়ে গড়িয়েছে তখনই আপত্তি দেখা দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের সন্তানরা অবশ্যই পিতৃস্নেহ এবং সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত। বাবার সহযোগিতা পেলে তারা এগিয়ে যেতেন, সেক্ষেত্রে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী ৩ প্রজন্মকেও যদি কোটা সুবিধা দেওয়া হয় ক্ষতিপূরণ হিসেবে, মনে হয় অযৌক্তিক হবে না। সংবিধানে উল্লেখিত সুবিধাবঞ্চিত পিছিয়ে পড়া হিসেবে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধারা সম্মান হিসেবে যেহেতু নিজেরা কোটা সুবিধা পেয়েছেন তাই তাদের সন্তানদের যোগ্যতর করার সুযোগ তারা পেয়েছেন। সেক্ষেত্রে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান পর্যন্ত কোটা সুবিধার যৌক্তিকতা আছে। নাতি-নাতনি পর্যন্ত এই সুবিধা সম্প্রসারিত হলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসতেই পারে।

এই মুহূর্তে আন্দোলনকারীদের দাবি, তাদের আন্দোলনে রাজপথে নামার বিষয়টি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে, যা উদ্বেগের কারণ। এদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোও একাত্মতা প্রকাশ করছে। যাকে গুরুত্বসহ দেখতে হবে। সরকার আন্দোলন প্রশ্নে নমনীয় অবস্থানে থাকার কারণে তারা সাধুবাদ পেতে পারেন। কিন্তু একইসঙ্গে বলা যায়, এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালে এমন আন্দোলন দীর্ঘায়িত না করাটাই যুক্তিসঙ্গত। এ থেকে মুক্তির কী পথ হতে পারে।

আন্দোলনকরীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ গ্রহণযোগ্য হবে না। দুঃখজনক হচ্ছে, আন্দোলনকারীদের আলোচনায় বসানোর কোনও উদ্যোগ এই পর্যন্ত চোখে পড়েনি। দ্বিতীয় দিনই সরকার তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারতো। বাস্তবতা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আন্দোলনকারীদের প্রতি নমনীয় হওয়ার নির্দেশ ছাড়া তাদের  ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কার্যকর কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। সরকার অতি দ্রুত যদি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিধি, শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনার ব্যবস্থা করে সেটা হবে উত্তম পথ। কোটা সংস্কারের প্রস্তাব নিয়েও আলোচনা হতে পারে।

সর্বশেষ এই নিবন্ধ লেখার সময় ১০ জুলাই আদালতের রায়ে ২০১৮ সালে জারি করা সরকারের পরিপত্রকে বহাল করা হয়েছে। রায় ঘোষণার পরপর আন্দোলনকারীরা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তাদের আন্দোলন চলবে। তবে তারা এটাও বলেছে, তাদের আন্দোলন আদালতের বিরুদ্ধে নয়, সংসদে আইন করে কোটা বাতিল করতে হবে। কমিশন গঠন করতে হবে, তা না হলে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবে।

আদালতের রায়ের ফলে তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে আবার প্রশ্ন আসতে পারে। আদালতকে শ্রদ্ধা জানালে তাদের শিক্ষায়তনে ফিরে যাওয়াটাই হবে যৌক্তিক। এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা কাম্য।

পরীক্ষার্থী, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ হ্রাসের জন্য এটা খুবই জরুরি বলে মনে করি। এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরাও বুধবার জাতীয় জাদুঘরের সামনে কোটা বহালের দাবিতে অবস্থান করছিলেন। আন্দোলনকারীদের মতো তারাও শান্তিপূর্ণ অবস্থান করেছেন। শুধু তাই নয়, তারা উচ্ছৃঙ্খলতা এড়াতে আন্দোলনকারীরা আসার পর তাদের অবস্থান স্থগিত করে শাহবাগ ত্যাগও করেন। এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের জন্য অবশ্যই উভয়পক্ষই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

আন্দোলনকারীদের এই মুহূর্তে বিবেচনা করতে হবে, সরকার ও আদালত সবাই তাদের দাবির প্রশ্নে এক। সুতরাং তাদের জনদুর্ভোগ সৃষ্টি না করে ক্লাসে ফিরে যাওয়াই হবে উত্তম। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদেরও ভাবতে হবে, দেশের শেষ ভরসা হচ্ছে আদালত। এবং বুধবার জাদুঘরের সামনে তারা অবস্থানকালেও একই কথা বলেছেন। তারা বলেছেন আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন। এখন আদালতের রায় হয়েছে। তাদেরও কোনও আন্দোলন করা যৌক্তিক হবে না। সবাই মিলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দেশকে সুন্দর পরিবেশে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি করাই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চাওয়া।

লেখক: সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও শিশুসাহিত্যিক।

(প্রকাশিত লেখাটির মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে কোন আইনগত ও অন্য কোন ধরনের দায়-ভার মিরর টাইমস্ বিডি বহন করবে না)।

⠀শেয়ার করুন

loader-image
Dinājpur, BD
ডিসে ১১, ২০২৪
temperature icon 15°C
scattered clouds
Humidity 46 %
Pressure 1015 mb
Wind 3 mph
Wind Gust Wind Gust: 3 mph
Clouds Clouds: 44%
Visibility Visibility: 10 km
Sunrise Sunrise: 06:41
Sunset Sunset: 17:15

⠀আরও দেখুন

Scroll to Top