আমীন আল রশীদ : ছুটির দিন শুক্রবার সকালে ঘুম ভাঙে ফায়ার সার্ভিসের একজন সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ফোনে। খুবই বিমর্ষ। আগের রাতে রাজধানীর বেইলি রোডে যে ভয়াবহ আগুনে অন্তত অর্ধশত মানুষের প্রাণ গেলো, সেই ঘটনায় তিনি নিজের কিছু পর্যবেক্ষণ বললেন। সেইসাথে ব্যক্ত করলেন কিছু হতাশা।
এই শহরে এই ধরনের আগুনে নিরীহ মানুষের প্রাণহানি নতুন কোনও খবর নয়। বরং প্রতিটি ঘটনাকেই আমরা ‘দুর্ঘটনা’ বলে মেনে নিয়ে পরের ঘটনার জন্য অপেক্ষা করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সেইসঙ্গে যে মানুষগুলো পুড়ে লাশ হয়, সেটি সরকারের পরিসংখ্যানে কিছু নতুন সংখ্যাই কেবল যোগ করে। যে কারণে বা যাদের অনিয়ম-দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা আর গাফিলতির কারণে এই মানুষগুলোর জীবন এবং তাদের পরিবারগুলো তছনছ হয়ে যায়, তাদের জন্য কেবল রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের কিছু শোক, কিছু সমবেদনা, কিছু ক্ষতিপূরণ।
একটি শহরে দুই কোটি বা তারও বেশি মানুষের বসবাস। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের পুরো ভূখণ্ডেও এত মানুষ থাকে না। কেন সবাইকে ঢাকায় আসতে হয় এবং মূলত জীবিকা ও শিক্ষার প্রয়োজনে এসে কেন তাদের লাশ হয়ে ফিরতে হয়—সেই প্রশ্ন বহু বছর ধরেই জনপরিসরে আছে। রাষ্ট্রও জানে এই প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু তারপরও দেশের সবকিছু এই একটি শহরে। পুরো দেশটাই যেন কাঁত হয়ে পড়েছে ঢাকা শহরের ওপরে।
রাষ্ট্রের কাছে যে মৃত্যুগুলো নিছকই সংখ্যা— নিহতদের পরিবারের কাছে সেগুলো সারা জীবনের শূন্যতা, যন্ত্রণা। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী যে ব্যক্তিটি মরে গেলেন; রাষ্ট্রের যে দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেম বা দুর্বলতার কারণে যারা প্রকৃতপক্ষে খুন হলেন, সেইসব পরিবারের দায়িত্ব কি রাষ্ট্র নিয়েছে কখনও?
যে ভবন মালিকের গাফিলতির কারণে এই ধরনের মৃত্যু হয়, তারা কি এই হত্যাকণ্ডের দায় নিতে প্রস্তুত? ধরা যাক, তাদের বিচার হলো। বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তি হলো। তারপরেও কি যারা প্রিয়জন হারিয়েছেন, তাদের কোনও লাভ হবে? নিহত ব্যক্তি কি আর ফিরে আসবেন? মানুষের জীবন চলে গেলে কোনও কিছুর বিনিময়ে কি সেই শূন্যতা পূরণ করা যায়?
ঢাকা শহরের অধিকাংশ বহুতল ভবনেই যে অগ্নিনির্বাপনের জন্য আধুনিক ব্যবস্থা নেই; হাইড্র্যান্ট সিস্টেম নেই; বহুতল ভবনে কোনও কারণে আগুন লাগলে দ্রুত ভবন থেকে বের হওয়ার যে উপায় নেই— সেটি বোঝার জন্য কোনও গবেষণার প্রয়োজন নেই। বরং এই লেখাটি যিনি পড়ছেন, তিনি তার নিজের ভবনেও খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। অর্থাৎ মানুষ কোটি কোটি টাকা খরচ করে আধুনিক বহুতল ভবন বানাবেন, কিন্তু সেখানে যারা থাকবেন, তাদের জীবনের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার কোনও ব্যবস্থা রাখা হবে না।
যিনি এই লেখাটি এখন পড়ছেন— আপনি একটু অসুন্ধান করে দেখতে পারেন যে আপনার ভবনের বৈদ্যুতিক লাইন কতটা নিরাপদ। আপনার বাসার গ্যাস লাইন কিংবা সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করলে তার ব্যবস্থাপনাটি কতটা আধুনিক। কতটা সুরক্ষিত। আপনার ভবনের এসিগুলো কতটা ঝুঁকিতে আছে। গরম আসছে। এসির ব্যবহার বাড়বে। ফলে এসির দুর্ঘটনায় আগুনের ঘটনাও বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু আপনার নিজের বাড়ির এসি ঠিকঠাক আছে কিনা, সেই খোঁজটিও কি আপনার কাছে আছে?
ভবন নির্মাণ করতে গেলে একটা বিল্ডিং কোড বা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মানতে হয়। রাজধানী ঢাকার শতকরা কতগুলো ভবন ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মেনে তৈরি করা হয়েছে, রাজউকের কাছে সেই তথ্য আছে কিনা সন্দেহ। কেননা কোন প্রক্রিয়ায় ভবন নির্মাণের অনুমোদন পাওয়া যায় এবং নিয়ম না মেনে ভবন বানালেও ভবন মালিকদের কেন কিছুই হয় না— সেটি খুলে বলার কোনও প্রয়োজন নেই। দুর্নীতিতে নিমজ্জিত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে পয়সার বিনিময়ে যেকোনও সেবাই পাওয়া যায়। আবার ঘুষ না দিলে আপনার যে সেবাটি পাওয়া অধিকার, সেটিও নাও পেতে পারেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে গত অর্ধ শতাব্দীতে দেশে কৃষি, অর্থনীতি ও অবকাঠামো খাতে যে অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছে, সেটি অস্বীকার করার কোনও সুযোগ নেই। কিন্তু এইসব উন্নয়ন ও অগ্রগতি বারবার মুখথুবড়ে পড়ে যার কাছে, তার নাম দুর্নীতি।
বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সূচকে বাংলাদেশ বরাবরই শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকার উপরের দিকে থাকলেও সব আমলে সব সরকার সেটি অস্বীকার করে। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে দুর্নীতির ভয়াবহতা বোঝার জন্য টিআই বা অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানের জরিপের প্রয়োজন হয় না। সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত তার জীবনের মূল্য দিয়ে সেটি বোঝে।
জাতীয় পরিচয়পত্র নামে যে আইডি কার্ড একজন মানুষের জন্মগত অধিকার— সেটি পাওয়ার জন্যও মানুষকে কী ভয়াবহ হয়রানির মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেটি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসে তো বটেই, প্রতিটি জেলা শহরের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে খোঁজ নিলেই জানা যাবে।
যে জন্মনিবন্ধন ও পাসপোর্ট পাওয়া একজন নাগরিকের জন্মগত অধিকার, সেটি পেতে গিয়েও মানুষকে কী ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়, তা ভুক্তভোগী প্রতিটি মানুষ জানেন। অথচ স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন পাসপোর্ট পেতে গিয়ে মানুষকে যেন ‘উহ’ শব্দটিও করতে না হয়। কিন্তু তার এই নির্দেশনার পরে দেশে পাসপোর্ট অফিসগুলো কতটা বদলেছে?
রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে বরাবরই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহনশীল নীতির ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু কার্যত কোন প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি বন্ধ হয়েছে বা কমেছে, সেটি নিশ্চিত নয়। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে হয়তো কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে, কিন্তু সেটি যে প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে অনেক কম, সেটি দেশের প্রতিটি মানুষ স্বীকার করবেন। প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত করার ব্যাপারে সরকার যে জিরো টলারেন্সের কথা বলে, সেটি তারা নিজেরা কতটা বিশ্বাস করে এবং চর্চা করে?
রাজউকের নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণ করলে এবং ফায়ার সার্ভিসের সঠিক তদারকি থাকলে কিছুদিন পরপর কীভাবে একেকটি ভবনে আগুন লেগে এভাবে নিরীহ মানুষের প্রাণ যায়? তার মানে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ম্যানেজ করে ভবন মালিকরা বছরের পর বছর ধরে অন্যায় করে পার পেয়ে যাচ্ছেন?
যেকোনও দুর্ঘটনার পরে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর খুব সাধারণ অজুহাত জনবল ও বাজেট সংকট। ১৮ কোটি লোকের দেশে জনবল সংকট হয় কী করে? নাগরিকের জীবন সুরক্ষার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোয় কেন জনবল ও বাজেটের সংকট থাকবে? প্রশাসনের বিভিন্ন পদে প্রয়োজনের অতিরিক্ত লোকবল এবং পদোন্নতির ভারে অনেক চেয়ার ন্যূব্জ হয়ে পড়ার খবর গণমাধ্যমে মাঝেমধ্যেই আসে। অথচ মানুষের জীবন বাঁচানোর তথা বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সবার আগে ছুটে যেতে হয়, সেখানে লোকবল, যন্ত্রপাতি ও বাজেটের সংকট থাকবে কেন?
আবাসিক ভবনে হোটেল রেস্টুরেন্ট আছে এমন ভবনে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানুষ বসবাস করবে কেন? পুরান ঢাকার অসংখ্য ভবনের নিচতলায় বা বেজমেন্টে কেমিক্যালের গোডাউন। উপরে মার্কেট এবং শত শত মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করে। প্রতিটি দুর্ঘটনার পরে সরকারের তরফে বলা হয়, কোনও আবাসিক ভবনে কেমিক্যালের গোডাউন থাকতে পারবে না। কিন্তু এই মুহূর্তে পুরান ঢাকার কতগুলো আবাসিক ভবনের নিচে কেমিক্যাল বা অন্য কোনও দাহ্য বস্তুর গোডাউন আছে—তার সঠিক পরিসংখ্যান কি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে আছে? এগুলো দেখার দায়িত্ব কার? যাদের দেখার দায়িত্ব তারা কি ঠিকমতো নিজেদের কাজটি করেন? যদি না করেন তাহলে তার কারণ কি রাষ্ট্র খতিয়ে দেখেছে বা দেখতে চায়? নাকি বেইলি রোডের এই আলোচনা চলতে চলতে আমরা নতুন কোনও ইস্যুর ফাঁদে ঢুকে যাব?
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।
(প্রকাশিত লেখাটির মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে কোন আইনগত ও অন্য কোন ধরনের দায়-ভার মিরর টাইমস্ বিডি বহন করবে না)।