মিরর ডেস্ক : ‘আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু/দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয়-কেতন।’ কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাবকে এভাবেই স্বাগত জানিয়েছিলেন বাঙালির সাহিত্যাকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর ‘বিশ্ববিধাত্রীর চির-বিস্ময়’ হিসেবে পরাধীন ভারতবর্ষে আবির্ভূত হয়ে নজরুল একই সঙ্গে ছড়িয়েছিলেন প্রেম ও দ্রোহের বার্তা। বলেছেন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য’।
১৩০৬ বঙ্গাব্দে ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে) জন্ম নিয়েছিলেন বাংলাসাহিত্যের ভাষা পাল্টে দেওয়া কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে মা জাহেদা খাতুন, বাবা কাজী ফকির আহমেদের ঘরে জন্ম ‘দুখু মিয়া’ নামে। যৌবনে বাংলাকে কাঁপিয়ে পরিণত হয়েছেন প্রবাদপ্র্রতিম ব্যক্তিত্বে।
আজ শনিবার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী। জন্মবার্ষিকী উদযাপনে এবারের প্রতিপাদ্য- ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং নজরুল’। জাতীয় পর্যায়ে কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কবি নজরুল তাঁর প্রত্যয়ী ও বলিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তিসংগ্রামে অনুপ্রাণিত ও উদ্দীপ্ত করেছেন। নজরুল সাহিত্যের বিচিত্রমুখী সৃষ্টিশীলতা আমাদের জাতীয় জীবনে এখনও প্রাসঙ্গিক।
মাত্র ৯ বছর বয়সে বাবাকে হারানোর আগে থেকেই দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবনের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে হয় কাজী নজরুল ইসলামকে। বাবার মৃত্যুর পর মুয়াজ্জিন হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন স্থানীয় মক্তবে। বিদ্যায়তনে গেলে তার পড়াশোনার পাট বারবার থমকে গেছে অভাব-অনটনে। ১৯২২ সালে লেখা ও প্রকাশিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্য দিয়ে অপ্রতিহত যাত্রা শুরু করেন তিনি। আরবি ও ফারসি ভাষা ও সাহিত্যে তার দক্ষতা এবং নিজের লেখায় এর সফল প্রয়োগ তার সাহিত্যকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কবি নজরুল সৈনিক হিসেবে নাম লেখান বেঙ্গল রেজিমেন্টে। সেখান থেকে ফিরে এসে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন তিনি। অসাম্প্রদায়িকতার মূর্ত প্রতীক নজরুল যেমন ইসলামি সংগীত বা গজল রচনা করেছেন, তেমনিভাবে শ্যামাসংগীত আর ভজনও রচনা করেছেন।
নজরুলের সাহিত্যজীবন থমকে যায় মাত্র ৪৩ বছর বয়সে, ১৯৪২ সালে। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে কবির বাকশক্তি থেমে যায়, মানসিক ভারসাম্যও হারান তিনি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উদ্যোগ নিয়ে কবি নজরুলকে সপরিবারে নিয়ে আসেন বাংলাদেশে, বন্দোবস্ত করা হয় সুচিকিৎসার। পরে তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়। ১৯৭৬ সালে দেওয়া হয় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। একই বছরের ২৯ আগস্ট পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। কাজী নজরুলের রচিত ‘চল চল চল’ গানটি বাংলাদেশের রণসংগীত।
কর্মসূচি : জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় তিন দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। দিনের সূচনাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে কবির সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয়।
জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন হবে বিকাল ৪টায় রাজধানীর শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে। উদ্বোধন করবেন জাতীয় সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী। জাতীয় পর্যায়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারসহ অন্য অনুষ্ঠানমালা বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, বেসরকারি বেতার ও টেলিভিশন চ্যানেলসমূহ সম্প্রচার করবে।
এ ছাড়াও জাতীয় কবির স্মৃতিবিজড়িত ময়মনসিংহ, কুমিল্লার দৌলতপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ও স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে।
রাজধানীতে জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, ছায়ানট প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান।
ছায়ানটের তিন দিনব্যাপী নজরুল উৎসবের শুরু হয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার। আজ শনিবার ও আগামীকাল রবিবার সন্ধ্যা ৭টায় ধানমন্ডির ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবন মিলনায়তনে শুরু হবে উৎসবের আয়োজন। উৎসবে পরিবেশন করা হবে একক ও সম্মেলক গান, নৃত্য, পাঠ-আবৃত্তি। এতে ছায়ানটের শিল্পী ছাড়াও আমন্ত্রিত শিল্পী ও দল অংশ নেবে।