জোবাইদা নাসরীন : বাংলাদেশে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অনেক কিছু ঘটছে। প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পরপরই গণভবনে লুটপাটের মধ্য দিয়েই শুরু হয় সারা দেশে হামলা, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর আক্রমণ, মন্দির ও উপাসনালয় ভাঙচুর, লুটপাট এবং ডাকাতি। ভাঙা হয়েছে ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর, ম্যুরাল, বিভিন্ন জাদুঘর, সাত বীর শ্রেষ্ঠ’র ছবি এবং মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতি। ধ্বংস করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ম্যুরালসহ আরও অনেক স্থাপনা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ। অবস্থা এমন হয়েছে যে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বেশিরভাগ থানায় এখন পুলিশের কোনও সদস্য অবস্থান করছেন না।
সেদিন সারা রাত অনেকের মতো আমাদের কাছেও প্রচুর ভিন্ন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীর ফোন এসেছে, তাদের বাড়িতে হামলা হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু কে নিরাপত্তা দেবে? কারা দায়িত্ব আছে দেশের মানুষের নিরাপত্তার? সেটি কেউই জানে না।
কিছু একটা যে ঘটতে যাচ্ছে সেটি অনেকেই প্রথম বুঝতে পারে টিভি স্ক্রলের মাধ্যমে। বিশেষ করে যখন টিভি চ্যানেলগুলোতে সেনাপ্রধান দুপুর ২টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। এবং জনগণকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার আহ্বান জানানো হয়। কারণ সেনাপ্রধানদের সাধারণত জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার রীতি নেই। নিশ্চয়ই এমন কিছু ঘটেছে যে কারণে সবার সামনে সেনাপ্রধানকে দাঁড়াতে হচ্ছে। কিন্তু সেই ক্ষণ থেকেই মানুষের চোখ স্থির ছিল বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে। কী জানাবেন সেনাপ্রধান? শেখ হাসিনার পদত্যাগ তখন অনুমেয়। দুপুর দুইটায় সেনাপ্রধান ভাষণ দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি আর প্রচার হচ্ছিল না। একটু পর স্ক্রলে দেখাচ্ছিল সেনাপ্রধান রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন। তখন স্বাভাবিকভাবেই মনে আসছিল এই ক্রান্তিলগ্নে তাহলে কে দায়িত্ব নিচ্ছেন দেশের? কারা কারা কি দায়িত্ব পালন করবেন? এর আগেই অনেকে হিসাব-নিকাশ করতে বসে গিয়েছিলেন। বিভিন্ন ফোরাম থেকে আলোচিত হয়েছে নানাজনের নাম। বলতে দ্বিধা নেই সেখানেও প্রাধান্য পেয়েছে নানা ধরনের রাজনীতি।
তবে কাদের ডেকেছেন সেনাপ্রধান সেটিও তখন পর্যন্ত জানা যায়নি। টুকটাক কয়েকজনের নাম বিক্ষিপ্তভাবে গণমাধ্যম জানাচ্ছিল।
প্রায় দুই ঘণ্টা পর সেই কাঙ্ক্ষিত ভাষণ নিয়ে হাজির হলেন সেনাপ্রধান। তিনি তার বক্তব্যে জানালেন বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। সাংবাদিকরা যখন জানতে চাইলেন কারা কারা এই ছিলেন সভায়? উত্তর শুরু করলেন তিনি জামায়াতের আমির দিয়েই। হেফাজতে ইসলাম, বিএনপি, জাতীয় পার্টির নেতা ছিলেন। আরও জানালেন শিক্ষার্থীদের পক্ষে এবং তাদের বার্তা দেওয়ার জন্য অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলকে ডেকেছেন। সেনাপ্রধানের এই যুক্তিতে আমি একমত। পরিস্থিতির কারণেই আওয়ামী লীগের কাউকে রাখা যায়নি। কিন্তু বাংলাদেশ আরও অনেক প্রাচীন দল আছে, তাদের ডাকা হলো না কেন? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি জামায়াত কীভাবে প্রধান রাজনৈতিক দলের মর্যাদা পেলো?
এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে কী প্রক্রিয়ায় বা কোন মানদণ্ড বা বিচারে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত আর হেফাজত সেনাপ্রধানের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে? আমন্ত্রিত ১৮ জনের আলোচনায় ৮ জনই ছিলেন জামায়াত আর হেফাজত এবং অন্যান্য ইসলামিক দলের সদস্য। কারা এই আমন্ত্রণের সুপারিশ করেছেন? বিষয়টি এমনও না যে বাংলাদেশে জামায়াত বা হেফাজত কখনও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে প্রমাণ করেছে যে তাদের অনেক জনসমর্থন আছে। সব সময়ই তারা অন্যের ঘাড়ে ছিল। আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের মানুষ খুব কমই জামায়াতকে কদর করেছে।
অনেকেই বলছেন এখন দেশ গড়ার সময়। এখন এই প্রশ্ন নয়। কেন নয়? জামায়াতকে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর একটির মর্যাদা দিয়ে দেশ গড়ার কথা ভাবছেন? জামায়াতকে আশকারার যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না। যখনই টেলিভিশনে দেখালো জামায়াত এবং হেফাজতের নেতারা গাড়ি থেকে নামছেন, হাসছেন, সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করছেন, আর তখনই মহা-উল্লাসে ভাঙা হচ্ছে আমার বাসার সামনের ভাস্কর্য। আমাদের মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রীয় কদরের তাৎপর্য সবাই বোঝে। একেবারেই বলা যায় যে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জামায়াত এবং হেফাজতের এই গুরুত্ব সাম্প্রদায়িকতাকে উৎসাহ দিয়েছে, উসকে দিয়েছে।
তাই বক্তব্যে কোনও গাই-গুই নেই। নতুন বাংলাদেশ গড়াই যদি আমাদের প্রত্যয় হয় তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যেমন কোনোভাবেই থাকতে পারবে না কোনও নারীবিদ্বেষী, জাতিবিদ্বেষী, ধর্মবিদ্বেষী এবং ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা কেউ। দেখি না কী হয়, আরও কয়েক দিন যাক, আরও পরে এই বিষয়ে কথা বলবো– এসব যুক্তি জামায়াতের আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার অনুমোদন দেয়। এখনই যদি আমরা এই চেষ্টাকে থামাতে না পারি তাহলে এর পরিণাম কিন্তু আমাদেরই ভোগ করতে হবে। দ্বিতীয়বার দেশ স্বাধীনের অর্থ এই নয় যে প্রথমবারের মুক্তির সংগ্রামকে দুমড়ে-মুচড়ে অস্বীকার করা? একাত্তরে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে তাদের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের একটি হিসেবে স্বীকার করা নেওয়া। প্রথম স্বাধীনতার ইতিহাসকে সঙ্গে নিয়েই দ্বিতীয় স্বাধীনতা।
তাই নতুন বাংলাদেশের পরিকল্পনার নকশায় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল এবং ধর্ম, জাতি, লিঙ্গবিদ্বেষকে বাদ দিতে হবে। এর বাইরে সমতা এবং ন্যায্যতার বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার আর পুষ্ট হয়ে সতেজ থাকবে না।
লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
(প্রকাশিত লেখাটির মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে কোন আইনগত ও অন্য কোন ধরনের দায়-ভার মিরর টাইমস্ বিডি বহন করবে না)।