প্রভাষ আমিন : দেশ এখন নির্বাচনের জন্য তৈরি। ৭ জানুয়ারি ২০২৪ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কিন্তু দেশের রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। শুধু নির্বাচন নয়, বিএনপি পুরো নির্বাচনী ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ারই বাইরে রয়ে গেছে।
সহিংসতার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির অধিকাংশ সক্রিয় নেতা কারাগারে বা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়ায় বিএনপি কার্যত ভার্চুয়াল দলে পরিণত হয়। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি বার্তা বা নির্দেশ আসে, ঢাকার গোপন জায়গা থেকে সেই বার্তা বা নির্দেশ পড়ে শোনান রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। এভাবেই চলছে জাতীয়তাবাদী ভার্চুয়াল দল।
২৮ অক্টোবর ২০২৩-এর পর থেকে বিএনপি নিয়মিত বিরতিতে রুটিন করে হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু জনগণের সাড়া না পাওয়ায় সেই কর্মসূচিও হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। এরপর তারা যানবাহনে আগুন দিয়ে, ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মেরে ভীতি সঞ্চারের চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে স্বাভাবিক জনজীবনে বিঘ্ন সৃষ্টি করা যায়নি।
দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়, কেউ যাতে আদালতে কোনো মামলায় হাজিরা না দেন। কিন্তু চূড়ান্ত ও সর্বাত্মক আন্দোলনই সর্বাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ২০ ডিসেম্বর সর্বাত্মক অসহযোগ ঘোষণার পর থেকে বাংলাদেশের একজন মানুষও এই ডাকে সাড়া দেয়নি। এমনকি বিএনপির নেতাকর্মীরাও কেউ এই অসহযোগে সাড়া দেয়নি। কারণ অসহযোগে সাড়া দেওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
ইউটিলিটি বিল না দিলে গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতে ব্যাংকে লেনদেনও চালাতে হবে। বিএনপি নেতাদের কারও ব্যবসা-বাণিজ্য থেমে আছে বা বিল না দেওয়ার দায়ে কারও বাসায় সেবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে এমন খবর মেলেনি।
নির্বাচন যখন দ্বারপ্রান্তে, বিএনপির যখন তুমুল আন্দোলনে থাকার কথা; তখন তাদের খুঁজে পাওয়া মুশকিল। নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়ে হুটহাট লিফলেট বিলি করা ছাড়া তাদের আর কোনো কর্মসূচিও দেখা যাচ্ছে না। জনমনে কৌতূহল, শঙ্কা—৭ জানুয়ারি বিএনপি কী করবে? এই প্রশ্নের স্পষ্ট কোনো জবাব কি কারও কাছে আছে? নেই। এমনকি বিএনপি নেতাদের কাছেও এর কোনো সুনির্দিষ্ট জবাব নেই।
‘৭ জানুয়ারি নির্বাচন করে সরকার পার পাবে না, ভোটাররা কেন্দ্রে যাবে না’ ধরনের কৌশলী বক্তব্য দিয়েই তারা দায়িত্ব সারছেন। ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন বর্জন ও অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে ৬ জানুয়ারি সকাল ৬টা থেকে ৮ জানুয়ারি সকাল ৬টা পর্যন্ত (৪৮ ঘণ্টা) দেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। বৃহস্পতিবার (৪ জানুয়ারি) বিকেলে এক জরুরি ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
২০১৪ সালের নির্বাচনও বর্জন করেছিল বিএনপি। তবে সেইবার নির্বাচন ঠেকানোর সহিংস চেষ্টা করেছে বিএনপি। অগ্নিসন্ত্রাস, মানুষ পুড়িয়ে মারা, ভোট কেন্দ্র জ্বালিয়ে দেওয়া, রাস্তাঘাট অবরুদ্ধ করা—সব মিলিয়ে দেশজুড়ে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল বিএনপি।
তাতে নির্বাচন ঠেকানো যায়নি। বরং বিএনপির নামের সাথে সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা জুটে যায়। ২০১৪ সালের পর ২০১৫ সালেও বিএনপি দেশজুড়ে অগ্নিসন্ত্রাস চালিয়েছিল। কিন্তু সব বিবেচনায় নিজেদের ক্ষতি দেখে সন্ত্রাসের পথ থেকে পিছিয়ে আসে বিএনপি। তারপর ২৮ অক্টোবর ২০২৩ পর্যন্ত বিএনপি সংযতই ছিল। কিন্তু কথায় বলে না, কয়লা ধুলে ময়লা যায় না।
বিএনপিও তাদের সন্ত্রাসী চরিত্র লুকাতে পারেনি। ২৮ অক্টোবর ২০২৩ ব্যাপক সহিংসতায় তারা নিজেদের আসল চরিত্রে ফিরে যায়। কিন্তু ২৮ অক্টোবরের পর হরতাল-অবরোধের নামে যানবাহনে আগুন, ট্রেনে আগুন দিয়েও আন্দোলন জমাতে না পেরে আবার পিছটান দিয়েছে বিএনপি। এখন তারা সর্বাত্মক অবরোধ ডেকে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে।
মাঠে-ময়দানে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। বিএনপি বুঝতে পেরেছে, ২০১৪ সালের মতো সহিংস কায়দায় নির্বাচন ঠেকাতে গেলে বিদেশিদের সহানুভূতিও হারাতে হতে পারে। এমনকি সহিংস কায়দায় নির্বাচন ঠেকাতে গেলে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞায় পড়ার ঝুঁকিও আছে। তাই হয়তো তারা পিছিয়ে এসেছে।
এখন বিএনপির মূল লক্ষ্য ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত করা। এখানে বিএনপি একটু সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। বিএনপি অংশ না নেওয়ায় নির্বাচন পুরোপুরি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হচ্ছে না। প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ তৈরি করতে আওয়ামী লীগ তাদের বিদ্রোহীদের জন্য নির্বাচন উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তাতে অন্তত ১০০ আসনে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
এমনকি আওয়ামী লীগের অনেক বাঘা বাঘা নেতা, মন্ত্রী, এমপির জয়ও এখন ঝুঁকির মুখে। এই ১০০ আসনে হয়তো ভোটার উপস্থিতি ভালোই হবে। কিন্তু বাকি ২০০ আসনে কে জিতবেন, তা মোটামুটি নিশ্চিত। তাই সেইসব আসনে ভোটাররা কেন্দ্রে যাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে।
নিজেদের পছন্দের প্রার্থী জিতে যাবেন, এটা জেনে গেলে, অনেকে কেন্দ্রে যেতে চাইবেন না। এমনকি আওয়ামী লীগের সমর্থক অনেকেও হয়তো ভোট দিতে যাবেন না। অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ ৩৫ শতাংশের আশেপাশে ভোট পায়।
জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য অংশগ্রহণকারী দল ধরলে এই সংখ্যাটা ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এই ৪০ শতাংশ ভোটারদের কেন্দ্রে আনাই এখন আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। জয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়া আসনগুলোয় আওয়ামী লীগের সমর্থকরা ভোট কেন্দ্রে না গেলে বিএনপি সেইটা নিজেদের বিজয় হিসেবে দেখানোর সুযোগ পেয়ে যাবে। তারা দাবি করতে পারবে, তাদের ডাকে সাড়া দিয়েই ভোটাররা কেন্দ্রে যায়নি। বিএনপি এখন সেই আশায় বসে আছে।
বিএনপি মুখে যাই বলুক, নির্বাচনকে সামনে রেখে বা নির্বাচনের দিনে নাশকতা, গুপ্ত হত্যার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে ২০১৪ সাল থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রশাসন নিশ্চয়ই সতর্ক থাকবে।
সপ্তাহ দুয়েক আগেও বিএনপি নেতারা বলতেন, দেখেন না, নির্বাচন হবে না। এখন তারা বলছেন, এই নির্বাচন করে সরকার পার পাবে না। একই কথা আমরা ২০১৪, ২০১৮ সালেও শুনেছি। কিন্তু সরকার ঠিকই পার পেয়ে গেছে। ভোটার উপস্থিতি যাই হোক, ৭ জানুয়ারি নির্বাচন হয়ে গেলে বিএনপি কী করবে?
একটা গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করি। এক লোক তার প্রতিবেশীকে সহ্য করতে পারে না। প্রথমে বলল, সেই প্রতিবেশীর বিয়ে হবে না। বিয়ের পর বলল বাচ্চা হবে না। বাচ্চা হওয়ার পর বলল, লেখাপড়া করতে পারবে না। লেখাপড়ার করার পর বলল, পাস করতে পারবে না। পাস করার পর বলল, চাকরি পাবে না।
চাকরি পাওয়ার পর বলল, বেতন পাবে না। বেতন পাওয়ার পর বলল, স্থায়ী হবে না। বিএনপির অবস্থা এখন হয়েছে তাই, নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করতে তারা একের পর এক কথার বোমা চালিয়ে যাচ্ছে।
এখন দেখা যাক, ৭ জানুয়ারির পর সরকার পার পায় কি না?
লেখক : বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
(প্রকাশিত লেখাটির মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে কোন আইনগত ও অন্য কোন ধরনের দায়-ভার মিরর টাইমস্ বিডি বহন করবে না)।