ড. আনোয়ার খসরু পারভেজ : মাঙ্কিপক্স বা ‘এমপক্স’ নিয়ে উদ্বেগের নতুন কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে কারণ ভাইরাসজনিত এই রোগটি দ্রুত ছড়াচ্ছে। তাই এখনই এই ভাইরাসটির বিষয়ে বিশেষ সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
২০২২ সালের জুলাইয়ে মাঙ্কিপক্সের একটি ধরন ইউরোপ এবং এশিয়ার কিছুসহ প্রায় ১০০টি দেশে ছড়িয়ে পড়ে ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সেই প্রাদুর্ভাবের সময় সাতাশি হাজার মানুষ এতে আক্রান্ত হন ও সেই সময় এ রোগে অন্তত ১৪০ জনের মৃত্যু হয়। ২০২৪ এর শুরু থেকে শুধু কঙ্গোতে এমপক্সে আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি ও এ রোগে এখন পর্যন্ত ৫২৪ জনের অধিক মৃত্যু হয়েছে।
এরপর থেকে এটি বুরুন্ডি, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র কেনিয়া এবং রুয়ান্ডাসহ অন্যান্য আফ্রিকান দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে ও ১৬ আগস্ট পাকিস্তানে এমপক্স ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়েছে এবং আক্রান্ত ব্যক্তি উপসাগরীয় দেশ থেকে এসেছেন ও মাঙ্কিপক্স সংক্রামক রোগ ও এটি পশুবাহিত রোগ ও এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাস থেকেও অন্য কেউ এতে সংক্রামিত হতে পারে। তবে আশার কথা, এই রোগে সংক্রমিত রোগী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সেরে ওঠে, তাই এই রোগ খুব বেশি ভয়ঙ্কর নয়।
এ রোগে কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে, ১০০টির মধ্যে চারটির মৃত্যু ঘটায় ও ১৯৭০ সালে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে মানবদেহে মাঙ্কিপক্স ভাইরাস প্রথম শনাক্ত করা হয়। সেখানে ৯ বছর বয়সী এক শিশুর দেহে এই রোগ শনাক্ত হয়। এর দুই বছর আগেই দেশটি থেকে গুটিবসন্ত বিদায় নিয়েছিল। আফ্রিকায় দড়ি কাঠবিড়ালি, গাছ কাঠবিড়ালি, ডর্মিসের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির বানর এবং অন্যান্য প্রাণির মধ্যে মাঙ্কিপক্স পাওয়া গেছে।
গুটি বা জল বসন্তের সঙ্গে মাঙ্কিপক্সের উপসর্গের দিক থেকে সাদৃশ্য থাকায় অনেকেই প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগকে বসন্ত বা চিকেনপক্স বলে ভুল করছেন। এ রোগে প্রাণহানির সংখ্যা খুবই কম। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের মধ্যে সহজে মাঙ্কিপক্স ছড়ায় না। এটি করোনা ভাইরাসের মতো দ্রুত সংক্রামকও নয়। কিন্তু তবু সব দেশকে সাবধান হতে বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। চিকেন পক্সের মতো রোগের প্রতিকার থাকলেও এই বিরল রোগ নিরাময়ের এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি নেই বলেই জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রাপ্ত তথ্যমতে, এই রোগ মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রোগের লক্ষণ আছে এমন ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার মাধ্যমেই রোগটি ছড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করেছেন যে, সংক্রমিত ব্যক্তির রক্ত, শারীরিক তরল, শ্বাসনালী, শরীরে তৈরি হওয়া কোনো ক্ষত, নাক কিংবা চোখের মাধ্যমে কিংবা সংক্রমিত প্রাণির শ্লেষ্মার সরাসরি সংস্পর্শে এলে অন্যের শরীরের প্রবেশ করতে পারে মাঙ্কিপক্স ভাইরাস। রোগীর ড্রপলেট থেকেও এই রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে বলে স্বাস্থ্যকর্মী ও আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরাও ঝুঁকিতে থাকেন।
গুটিবসন্তের তুলনায় মাঙ্কিপক্স মৃদু উপসর্গ যুক্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঙ্কিপক্স এক বিশেষ ধরনের বসন্ত। এটি গুটিবসন্তের জন্য দায়ী ভাইরাসের পরিবারভুক্ত। জলবসন্ত বা গুটিবসন্ত তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি পরিচিত। তাই প্রতিকারও অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু এই মাঙ্কিপক্স ভাইরাসটি এতই বিরল যে এখনো এই ভাইরাসে আক্রান্তদের সুস্থ করতে নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসাপদ্ধতি চিকিৎসকদের জানা নেই। এই রোগের ভয়াবহতা নির্ভর করে ভাইরাস ছড়ানোর মাত্রাসহ রোগীর শারীরিক জটিলতার ওপর।
ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকারের পাবলিক হেলথ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার ইতিহাস রয়েছে ও বর্তমানে এমপক্সের ক্লেড আইবি ধরনটি দ্রুত সংক্রমিত হয়ে আফ্রিকা থেকে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ছে ও এ অবস্থায় বাংলাদেশকে তৈরি থাকতে হবে এবং তার সক্ষমতা যাচাই করার প্রয়োজনীয়তা আছে।
এ সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং প্রশাসনকে এমপক্সের উপসর্গ, সংক্রমণ ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত তথ্যাদি এবং ভাইরাসটিকে নির্ভুল ও দ্রুত নির্ণয়ের পদ্ধতি সমগ্র দেশজুড়ে কর্মরত সব স্বাস্থ্য কর্মীদের হাতে পৌঁছাতে হবে।
ভাইরাসটির ধরন নির্ণয়ে আধুনিক ল্যাব, যন্ত্র এবং দক্ষ লোকবল প্রয়োজন। এজন্য দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেওয়া দরকার। এই রোগের বিস্তার ঠেকাতে রোগটির প্রাদুর্ভাবের বিশেষ কোনো প্রবণতা, কারা বেশি ঝুঁকিতে আছেন, সংক্রমণের উৎস, মাঙ্কিপক্সে কোন টিকা কার্যকর হবে—এসব বিষয় নিয়ে গবেষণা করা জরুরি।
আমরা মনে করি, রোগটি নিয়ে মানুষের সতর্ক হওয়া উচিত। মাঙ্কিপক্স যেহেতু শারীরিক সংস্পর্শে আসার কারণে ছড়ায় তাই স্বেচ্ছা আইসোলেশন কিংবা স্বাস্থ্যবিধি মানার মাধ্যমে এটির বিস্তার সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
ফুঁসকুড়ি বা জ্বরের মতো লক্ষণ দেখে যারা ভাবছেন সংক্রমিত হয়েছেন, তাদের উচিত অন্যদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা।
টিকা থাকলেও সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা এটিই যে, আপনি চাইলেই নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারেন।
জনগণকে এমপক্স সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। হেলথ এমার্জেন্সিতে কী করবে তা জানানো জরুরি। দেশের জনগণের বিভিন্ন স্তরে পৌঁছানোর জন্য হেলথ ক্যাম্পিং, সোশ্যাল মিডিয়া, টিভি চ্যানেল ব্যবহার করতে হবে। এজন্য বাংলাদেশের হেলথ অথরিটি, সুশীল সমাজ ও সামাজিক সংগঠনগুলো একত্রে কাজ করা জরুরি।
মাঙ্কিপক্স নিয়ে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে সতর্কতা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাঙ্কিপক্স রোগী শনাক্ত হওয়ায় আগাম পদক্ষেপ হিসেবে এ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এয়ারলাইন্সগুলোর সতর্ক থাকতে এবং কোনো লক্ষণযুক্ত যাত্রী থাকলে দ্রুত স্বাস্থ্য বিভাগকে অবহিত করতে বলা হয়েছে।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে এমপক্সের কোনো রিপোর্ট নেই, তবে পাকিস্তান ও ইন্ডিয়াতে পাওয়া যাওয়ার কারণে ভবিষ্যৎ এই প্যানেডেমিক ঠেকাতে বাংলাদেশের স্থল, আকাশ এবং সামুদ্রিক সীমানা জুড়ে মানুষ, প্রাণি এবং পণ্যের চলাচল নিরীক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিকের থেকে আমরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তা কাজে লাগাতে হবে।
আমাদের যে কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী এবং ভলেন্টিয়ার আছে তাদের আক্রান্ত ব্যক্তিদের পিছনে কড়া নজরদারির জন্য রাখতে হবে যেন এটা ছড়িয়ে পড়তে না পারে। প্রয়োজনীয় ওষধপত্র সহজলভ্য করতে হবে। আমাদের ফার্মাসিটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিগুলো এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে।
এমপক্সের বিরুদ্ধে সফলতা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে ব্যাপক সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সফলতার চাবিকাঠি হবে পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ যা সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবিলায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে নেওয়া হয়।
আমরা মনে করি, অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রবীণ ও সম্ভাবনাময়ী তরুণদের সমন্বয়ে গঠিত বর্তমান বাংলাদেশ সরকার যদি এই মুহূর্তে কড়া নজরদারি, জনগণের সাথে কার্যকর যোগাযোগ এবং বৈদেশিক সাহায্য সহযোগিতা গ্রহণ করে তাহলে এমপক্সসহ অন্যান্য যে হেলথ এমার্জেন্সিগুলো আছে তার বিরুদ্ধে তারা জয়ী হতে সক্ষম হবে।
এই নতুন পাবলিক হেলথ ক্রাইসিসকে অতিক্রম করতে হলে আমাদের প্রয়োজন ক্রমাগত মূল্যায়ন, অভিযোজন এবং পারস্পরিক সহযোগিতা। এই প্রাদুর্ভাব বন্ধ করতে এবং জীবন বাঁচাতে একটি সমন্বিত অন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া অপরিহার্য ও সবার ন্যায়সঙ্গত অংশগ্রহণে মহামারি মোকাবিলা করতে হবে, সেজন্য অবশ্যই মহামারি চুক্তি সম্পাদন সম্পন্ন প্রয়োজন।
লেখক : গবেষক ও অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
(প্রকাশিত লেখাটির মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে কোন আইনগত ও অন্য কোন ধরনের দায়-ভার মিরর টাইমস্ বিডি বহন করবে না)।