মোস্তফা হোসেইন :
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের উত্তাপ কমতে না কমতেই উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু। আবার ৪৯৫ উপজেলায় নির্বাচনি হাওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে তাই কথা হতেই পারে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। ২০১৯-এর উপজেলা নির্বাচনে ওয়াকওভার পায় আওয়ামী লীগ। চমক সৃষ্টি করে ১১৫টি উপজেলায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিজয় মাধ্যমে। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন বর্জন করলেও বিদ্রোহ করতে দেখা যায় কিছু স্থানীয় নেতাকে। যতটুকু মনে আসে তাদের কয়েকজন স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে বিজয়ীও হয়েছিলেন।
এই বর্জনের ধারাবাহিকতা বিএনপি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও ধরে রেখেছে। আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে দলগতভাবে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে এমন কোনও আভাস এখনও পাওয়া যাচ্ছে না।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তারা অংশ নেয়নি সরকারের প্রতি অনাস্থার প্রতীক হিসেবে। উপজেলা নির্বাচনকালে যে আস্থা ফিরে পাবে এমন সম্ভাবনা নেই। ফলে এবারও আওয়ামী লীগ ওয়াকওভার পাবে এমনটা অনেকেরই ধারণা।
গত উপজেলা পরিষদ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তাদের অনুপস্থিতিতে নির্বাচন থেমে থাকেনি। তবে থেমে ছিল– তাদের বিশাল কর্মী বাহিনীর কর্মযজ্ঞ। যে কারণে সংসদীয় নির্বাচন যতটা উৎসবমুখর হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। গত সংসদ নির্বাচনে তাদের কর্মীরা দেখেছে, প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের কর্মীরা নাকের ডগায় কীভাবে নির্বাচনি উৎসবে মেতে উঠেছিল। তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যখন উৎসব করছিল, তখন তারা মাঘের আগেই মাঘের শীতে কাতর হয়ে পড়েছিল। প্রকৃত মাঘের আগেই আবার ঘোষণা এসেছে, মার্চ থেকেই শুরু হচ্ছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। তারা আত্মজিজ্ঞাসার মুখে– তাদের দল কি উপজেলা নির্বাচনও বর্জন করবে?
এমন পরিস্থিতিতে একটি নয় দুটি নির্বাচন থেকে দূরে থেকে ওই কর্মীদের কি দলটি ধরে রাখতে পারবে? অনেকেই মনে করছেন, বিএনপি হয়তো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া নির্বাচনে থাকবে। আওয়ামী লীগ যেমন তাদের দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের পাশাপাশি স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থী হওয়ার পথ খুলে দিয়েছিল, বিএনপি হয়তো তাই অনুসরণ করবে। অর্থাৎ কেউ নির্বাচন করলে তারা বাধা দেবে না। আবার কাউকে মনোনয়ন দিয়ে দলীয়ভাবে অংশগ্রহণের সুযোগও দেবে না। দ্বাদশ সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যেমন দলীয় নেতাকর্মীদের প্রার্থিতা মুক্ত করে দিয়েছিল, বিএনপিও চুপ থেকে তাদের নেতাকর্মীদের কি মুক্ত করে দেবে? কিন্তু এখানে তাদের আন্দোলনের অস্তিত্বও প্রশ্নের মুখে পড়বে। সেই ক্ষেত্রে বিদ্রোহ অবশ্যম্ভাবী।
বলা যায়, আগামী উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিএনপি সাংগঠনিকভাবে বর্জন করলেও তাদের নেতাকর্মীরা সেই নির্বাচনকে অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করবে। ওই অবস্থায় বিএনপি নেতাকর্মীদের দলীয় আনুগত্যের বিষয়টিও প্রশ্নের মুখে পড়বে। বিএনপিতে বিভক্তি আনার প্রয়োজনে আওয়ামী লীগ এবারও অন্তত চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেবে এমন আভাস পাওয়া যায়। ভাইস চেয়ারম্যান পদ উন্মুক্ত করে দিয়ে তাদের দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতিযোগিতার সুযোগ করে দেবে এটাও আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আভাস পাওয়া গেছে।
সাধারণ একটি প্রবণতা হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচনের তুলনায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে থাকে। কারণ, প্রার্থীরা নিজ এলাকায় থাকেন এবং তাদের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগও বেশি। বিএনপির সামনে এখন একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। তারা এমনও করতে পারে, আনুষ্ঠানিকভাবে বলবে তারা নির্বাচন বর্জন করছে। অন্যদিকে স্থানীয় নেতাকর্মীরা নির্বাচনে অংশ নিলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকবে। এতে বর্জন ও অর্জনের দুটি পথই খোলা থাকবে। নতুবা দলটি বিশাল শূন্যতার মুখে পড়বে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানের তিনটি পদের একটিতে মনোনয়ন দিয়ে দুটি উন্মুক্ত করে দিয়ে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার চেষ্টা করবে। এটা বিগত নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়। কিন্তু দ্বাদশ সংসদীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, এবার চেয়ারম্যান পদে বিদ্রোহী প্রার্থী অন্য সময়ের চেয়ে বেশি হবে। সংসদীয় নির্বাচনে বিদ্রোহীদের স্বীকৃতি দেওয়ার যে রীতি চালু হয়েছে, সেটি আরও শক্তিশালী হবে। এমন অবস্থায় ভবিষ্যতে দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা করা বড় দলটির জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থীকে তখন বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে তাই নতুনভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। জয়-পরাজয়ের চেয়ে এই নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সুশৃঙ্খল সংগঠন হিসেবে পরিচয়ের বিষয় হিসেবেও দেখা যাবে।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলে আওয়ামী লীগ অন্যরকম রাজনৈতিক সুবিধা পাবে। সাংগঠনিকভাবে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকাই শুধু নয়, নিজেদের সংগঠনের কর্মক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ পাবে। বিএনপি সেই সুযোগটি হারাবে। যা তাদের আন্দোলনের শক্তিকেও দুর্বল করে দেবে।
বিএনপি বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এভাবেও বিশ্লেষণ করছে। তাদের কথা- বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব ক্ষমতার রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। সংগঠন বিষয়ে তাদের নজর নেই। যার প্রমাণ কয়েক বছরে তাদের সাংগঠনিক ক্রিয়া-কর্ম মাধ্যমে প্রমাণ হয়। তারা হেনতেনভাবে ক্ষমতা লাভে উৎসাহী। সাংগঠনিক শক্তি প্রয়োজন গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতায় আসার জন্য। যেহেতু তারা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আগ্রহী নন, তাই তৃণমূলে শক্তি অর্জনের প্রতি তাদের দৃষ্টি না দেওয়াটাই স্বাভাবিক।
সুতরাং এটা ধরেই নেওয়া যায়, বিএনপি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে বর্জনেই আগ্রহী হবে। তবে এই প্রবণতা বিএনপিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এটা স্বাভাবিক।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
(প্রকাশিত লেখাটির মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে কোন আইনগত ও অন্য কোন ধরনের দায়-ভার মিরর টাইমস্ বিডি বহন করবে না)।