এম. এম. কায়সার : আপনার অভিজ্ঞতা আছে, ক্রিকেট খেলার। আপনি উইকেটকিপিংও করতে পারেন। কোনো এককালে আপনি দলকে জিতিয়েছিলেন। এখন আপনি বাজে ফর্মে আছেন। রানই পাচ্ছেন না এই ফরমেটে। এমনকি সিরিজের মাঝপথে একাদশ থেকে বাদ গেছেন এই রান খরা আর আজেবাজে ভঙ্গিতে খেলে আউট হওয়ার জেরে। এমন সময়ে আপনি জানলেন আপনি বিশ্বকাপ দলে আছেন।
উত্তর হলো—অভিজ্ঞতা, উইকেটকিপিংয়ের যোগ্যতা এবং কখন কোনো একদিন রানে ফিরতে পারে-এই আশায় আপনাকে নিয়ে বুক বেঁধেছেন নির্বাচকরা। আর আপনার জায়গায় অন্য যাদের ছবি নির্বাচকদের চোখে ভাসছে তাদের ওপর তেমন আস্থাও যে নেই!
কী আশ্চর্য বিকল্প নেই দেখে আপনি চরম অফফর্মে থাকা একজন ব্যাটারকে বিশ্বকাপ খেলতে পাঠিয়ে দিলেন! এই বিকল্প তৈরি করতে না পারার দায়টা কার?
খেলোয়াড় তৈরির প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত তারা কেউ এর দায় এড়াতে পারেন না। বাংলাদেশ যে বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে তা নিশ্চয়ই দু’মাস আগের কোনো খবর না। দু’বছর আগে থেকেই তো জানা এই বিশ্বকাপ ২০২৪ সালের জুনে হবে এবং বাংলাদেশ খেলবে।
একটু পেছনে ফিরে যাই। দু’বছর আগে ২০২২ সালের অস্ট্রেলিয়ায় টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন পরিষ্কার বলেছিলেন—‘আমাদের টার্গেট এই বিশ্বকাপ (২০২২) না, আমাদের টার্গেট দু’বছর পরের বিশ্বকাপ।’
তাহলে প্রশ্ন হলো, দু’বছর আগে থেকে যে বিশ্বকাপকে আপনি টার্গেট করেছেন সেই বিশ্বকাপে খেলতে যাওয়ার ১৬ দিন আগে এসে কেন আপনাকে নতুন করে খেলোয়াড় খুঁজতে হবে? কেন আপনি অফফর্মে থাকা একজন খেলোয়াড়কে বাধ্য হয়ে দলের সঙ্গে নিয়ে যাবেন? কেন আপনি তার বিকল্প আরও আগে থেকে ঠিক করে রাখবেন না?
এসব প্রশ্নের উত্তর একটাই—আমরা দু’বছর আগে যে বিশ্বকাপকে টার্গেট করার কথা বলেছিলাম, তা ছিল স্রেফ কথার কথা। সত্যিকার অর্থে কোনো সুপরিকল্পিত লক্ষ্য স্থির করা হয়নি।
যদি সত্যিকার অর্থেই লক্ষ্য ঠিক করা থাকতো তাহলে বিশ্বকাপ শুরুর মাত্র কয়েক মাস আগে নিশ্চয়ই আপনি টি- টোয়েন্টির নতুন অধিনায়ক ঘোষণা করতেন না। বিশ্বকাপের জন্য দল সাজানোর জন্য যে নতুন নির্বাচক কমিটি দায়িত্ব পেয়েছে তাদেরও মাত্র দু’সিরিজ আগে নিয়োগ দিয়ে বিসিবি জানিয়ে দিল আসলে এই বিশ্বকাপ নিয়ে সার্বিকভাবেই বোর্ডের পরিকল্পনাটা সুদূরপ্রসারী কোনোকিছু ছিল না।
লিটনের বিকল্প কে হতে পারেন, সেই হিসেবের অঙ্কও কষেছিলেন নির্বাচকরা। এক্ষেত্রে তাদের সামনে নাম ছিল এনামুল হক বিজয়। বিজয় কিপিংও করেন। কিন্তু সমস্যা হলো নির্বাচকরা যখন লিটনের জায়গা বিজয়ের নামটা নিয়ে আলোচনা করলেন তখন গলায় যে জোর পেলেন না।
বিজয়কে নিয়ে নির্বাচকরা ঠিক আস্থাবান হতে পারলেন না। তাই বাধ্য হয়ে অফফর্মে থাকা লিটন দাসের নামেই ভরসার খুঁটি গাড়লেন। প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে ১২টি দলের ২৪ জন ওপেনার এবং একডজন উইকেটকিপারের মধ্যে আর কেউ নির্বাচকদের আস্থাভাজন হতে পারলেন না!
প্রশ্ন হলো, তাহলে তারা খেলেন কেন? নাকি এই যে আস্থার অভাব সেই সমস্যাটা খোদ নির্বাচকদের? এবারের বিশ্বকাপ দল গঠন এসব প্রশ্নের চিহ্ন রেখে যাচ্ছে।
তাসকিন আহমেদ ইনজুরি নিয়েও বিশ্বকাপে গেলেন। তাও আবার সহ-অধিনায়ক হয়ে। অবাক করার বিষয় হচ্ছে তাসকিন কবে ইনজুরিমুক্ত হবেন? কবে ফিটনেস ফিরে পাবেন? কবে কোন ম্যাচ খেলবেন? আদৌ খেলতে পারবেন কিনা? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তরই জানে না কেউ। এমন অনিশ্চিত অবস্থায় থাকা একজন ক্রিকেটারকে কেন এবং কী কারণে সহ-অধিনায়ক হিসেবে দলে রাখা? এই প্রশ্ন রহস্য হয়েই থাকলো!
দল ঘোষণার পর প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর কাছে প্রশ্ন ছিল এমন। তবে সেই প্রশ্নের উত্তরে লিপু বলেন, ‘তিনি আরেক প্রজন্মের উদীয়মান একজন খেলোয়াড়, আরেকটি বিভাগের নেতৃত্ব দিচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় দলে খেলছে বিভিন্ন সংস্করণে। তার জন্য তাকেই হয়তো প্রত্যাশিত প্রার্থী মনে হয়েছে।’
পাঁজরের চোটে ভুগছেন দলের সহ-অধিনায়ক। শেষ পর্যন্ত তিনি খেলতে পারবেন তো? এমন প্রশ্নের উত্তরে লিপু বলেন, ‘যতটুকু তথ্য আছে, তা হলো বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে সে সুস্থ হয়ে উঠবে। আপনারা জানেন যে এবারের নিয়ম হলো একজন চোটে থাকা ক্রিকেটারকেও দলে রেখে টুর্নামেন্টে ঢুকতে পারবেন এবং উনি যদি ভালো হয়ে ওঠেন, তাহলে ভালো। আর না হলে পরিবর্তন করা যাবে। তবে তাসকিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে সিরিজ খেলতে পারছে না।’
তবে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচে ৮ জুন ২০২৪ শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে তাসকিন খেলতে পারবেন কিনা—সেই বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা এখনো নেই। দলের সহ-অধিনায়ককে নিয়ে যদি এমন অনিশ্চয়তা থাকে তাহলে কেনই বা তাকে দলে রাখা?
এই বিষয়ে প্রধান নির্বাচকের যে ব্যাখ্যা শোনা গেল তা এমন—‘যদি তাসকিন খেলতে না পারে, তাহলে বিসিবি বিষয়টা তাদের নজরে আনবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। এই মুহূর্তে আমি পরিষ্কার উত্তর দিতে পারছি না। যদি সে কোনো কারণে না খেলে, তবে তার পরিবর্তে অন্য কাউকে নেওয়া হবে। আশা করি, এমন কিছু না হোক।’
এবার ফিরি মোহাম্মদ সাইফুদ্দিনের বাদ পড়া প্রসঙ্গে। তানজিম হাসান সাকিব ও সাইফুদ্দিন—এই দুজনের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে গিয়ে নির্বাচকরা তানজিম হাসান সাকিবকে পছন্দের তালিকায় রেখেছেন। কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, সাইফুদ্দিনের পারফরমেন্স তাদের তুষ্ট করতে পারেনি।
একাগ্রতা, নিবেদন, জোশ এবং এফোর্ট—এসব বিষয়ের যোগফলে সাইফুদ্দিনকে ছাড়িয়ে নির্বাচকদের ভোট গেছে তানজিম হাসান সাকিবের বক্সে। জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে সিরিজে ৮টি উইকেট পেয়ে সিরিজ সেরা হয়েছেন তাসকিন আহমেদ। আর ঠিক তার সমান উইকেট পেয়ে বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়েছেন সাইফুদ্দিন।
কেন? এই কেন’র বিস্ময়ের হিসাবটাই যে মেলে না! অভিযোগ উঠেছে ম্যাচে সাইফুদ্দিন যথেষ্ট ইয়র্কার করেননি। প্রশ্ন হলো, সাইফুদ্দিনকে কি ইয়র্কার করার জন্য অধিনায়ক সেই সময় পরামর্শ দিয়েছিলেন? আর ইয়র্কারই কি একজন ব্যাটারকে আউট করার জন্য একমাত্র অস্ত্র?
যে কারণ দেখিয়ে সাইফুদ্দিনকে বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে তা খুবই দুঃখজনক। এই প্রথম জানা গেল কম ইয়র্কার করাটাও ক্রিকেটে বড় ‘অপরাধ’!
আইসিসির কাছে প্রাথমিক যে দলটা ১ মে ২০২৪ পাঠানো হয়েছিল তাতে মোহাম্মদ সাইফুদ্দিনের নাম ছিল। জিম্বাবুয়ে সিরিজে তিনি কম ইয়র্কার করায় ১৩ মে ২০২৪ রাতে চূড়ান্ত হওয়া বিশ্বকাপের দল থেকে তার নাম কাটা পড়লো! সাইফুদ্দিন তো ব্যাটিংও জানেন।
লেট অর্ডারে নেমে দুশো স্ট্রাইক রেটে রান করার ব্যাটিং সক্ষমতা আছে তার। টি-টোয়েন্টিতে এমন একজন ইউটিলিটি’র ক্রিকেটারকে বিশ্বকাপের ১৫ জনের দল থেকে আপনি বাদ দিলেন কিছু অসার যুক্তি তুলে। যে ক্রিকেটারকে নিয়ে বিশ্বকাপের জন্য লম্বা সময়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলল তাকে তো অন্তত ট্রাভেলিং রিজার্ভ খেলোয়াড় হিসেবেও দলের সঙ্গে রাখা যেত?
নাকি ইয়র্কার কম করা বোলারকে রিজার্ভ তালিকায়ও না রাখার নতুন এক ক্রিকেটের আইন বানিয়ে ফেললো বিসিবি? এইসব বিবেচনায় আনলে বাংলাদেশ ক্রিকেট বিশ্বকাপ দলের নাম ঘোষণায় চমক আসলে নেই, তবে বিস্ময়-প্রশ্নবোধক চিহ্ন আছে।
লেখক : সম্পাদক, স্পোর্টস বাংলা
(প্রকাশিত লেখাটির মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে কোন আইনগত ও অন্য কোন ধরনের দায়-ভার মিরর টাইমস্ বিডি বহন করবে না)।