আমীন আল রশীদ : ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার কলকাতায় খুন হয়েছেন—এমন সংবাদ নিয়ে যখন সারা দেশে তোলপাড় চলছে, তখনই জানা গেলো নিউইয়র্কের নিজ অ্যাপার্টমেন্টে ২০২০ সালের ১৩ জুলাই ফাহিম সালেহ নামে যে বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত তরুণ খুন হয়েছিলেন, তার নেপথ্যে রয়েছে টাকা এবং তিনি খুন হয়েছেন স্বয়ং বন্ধুর হাতে। এমপি আনারের ‘খুন’ হওয়ার সাথে এই ঘটনার মিল কোথায় সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। তার আগে দেখা যাক এমপি আনারের নিখোঁজ হওয়া তথা তার খুন হওয়া নিয়ে এখন পর্যন্ত কী জানা যাচ্ছে।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, স্নায়ুরোগের চিকিৎসা নিতে গত ১২ মে দর্শনা-গেদে সীমান্ত দিয়ে কলকাতায় যান এমপি আনার। কিন্তু পরদিন থেকেই রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন। মূলত সেদিনই (১৩ মে) তাকে হত্যা করা হয়। যদিও ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে বুধবার। ওইদিন রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
গোয়েন্দারা বলছেন, কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনে এমপি আনারকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর লাশ অসংখ্য টুকরা করে ছোট ছোট শপিং ব্যাগে ভর্তি করে ফেলে দেওয়া হয়। ফলে তার মরদেহ পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। তার মানে এমপি আনার যে সত্যিই খুন হয়েছেন, সেটি আসলে গোয়েন্দাদের ভাষ্য। এখন পর্যন্ত এর কোনও তথ্যপ্রমাণ মেলেনি। আর গোয়েন্দারা এই তথ্য দিচ্ছেন যাদেরকে সন্দেহভাজন হিসেবে ধরা হয়েছে তাদের বরাতে। যদিও তারা গোয়েন্দাদের কাছে আসলেই কী বলেছেন, সেটিও জানার কোনও উপায় নেই। কেননা পুরো বিষয়টি আদালতে ফয়সালা হবে। তার আগ পর্যন্ত গোয়েন্দাদের ভাষ্য মেনে নিতে হবে যে, এমপি আনার খুন হয়েছেন।
পুলিশের ভাষ্য মতে এমপি আনার কলকাতায় খুন হয়েছেন। অথচ খুনের পরিকল্পনা হয়েছে আরও আগেই এবং সেটি বাংলাদেশে বসে। যাদেরকে এই খুনের সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে বা পুলিশ নিশ্চিত বলে দাবি করছে, তারাও বাংলাদেশি এবং এমপি আনারের ঘনিষ্ঠ। প্রশ্ন হলো, তাকে বিদেশের মাটিতে খুন করা হলো কেন? খুনের পরে লাশ টুকটো টুকরো করা হলো কেন? যাতে কোনও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া না যায় সেজন্য? নাকি এ পেছনে অন্য কোনও ‘রাজনীতি’ আছে?
এমপি আনারের মৃত্যুর পরে জানা যাচ্ছে তিনি ছিলেন একজন চোরাচালানী এবং ইন্টারপোলের নোটিশও তার তার বিরুদ্ধে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, আনোয়ারুল আজিম আনার রাজনীতিতে আসার আগে চরমপন্থি গ্রুপের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদকদ্রব্য ও স্বর্ণ চোরাচালান, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি এবং চরমপন্থিদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে ৯টির বেশি মামলা ছিল। ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড আসামি হিসেবে পুলিশ একবার তাকে আটক করলেও তার ক্যাডাররা পুলিশের কাছ থেকে তাকে ছিনিয়ে নেয়। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যৌথ বাহিনীর অপারেশনের সময় দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিলেন আনার। (মানবজমিন, ২৩ মে ২০২৪)।
এমপি আনার খুন হওয়ার পরে প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে সামনে আসছে তার বাল্যবন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার আক্তারুজ্জামান শাহীনের নাম। দুজনেরই অবৈধ সোনার ব্যবসা ছিল। এই ব্যবসার ভাগ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে আনার খুন হন বলে শোনা যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, দুই যুগের বেশি সময় ধরে অবৈধ হুন্ডি ও স্বর্ণ চোরাচালানে আক্তারুজ্জামান শাহীন ও আনোয়ারুল আজিম আনারের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। সম্প্রতি তাদের মধ্যে অবৈধ স্বর্ণ চোরাচালানের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব হয়। সেই দ্বন্দ্বের জেরে বেয়াই আমানুল্লাহ সাঈদ ওরফে শিমুল ভুঁইয়াকে নিয়ে শাহীন কলকাতায় এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়েই ভারতে যান আনার। (যুগান্তর, ২৪ মে ২০২৪)।
যেভাবে খুনটি করা হয়েছে বলে পুলিশ বলছে, সেটি সিনেমাকেও হার মানায়। ঘনিষ্ঠজনদের যোগসূত্র না থাকলেও এত নিখুঁত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। তার মানে যদি এমপি আনার সত্যিই খুন হয়ে থাকেন, তাহলে তার পেছনে প্রধান কারণ টাকা। যে টাকার কাছে বন্ধুত্বেরও কোনও দাম নেই। দাম নেই কোনও সম্পর্কের, কোনও আবেগের। যে টাকার কারণেই নিউইয়র্কে খুন হয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ফাহিম সালেহ, যিনি রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তা ছিলেন। তার হাজার হাজার ডলার তছরুপ করার পর সেই ঘটনা লুকাতেই তাকে খুন করেন বন্ধু ও ব্যক্তিগত সহকারী টাইরেস হ্যাসপিল। তিনি ফাহিমের আর্থিক ও ব্যক্তিগত বিষয়গুলো দেখতেন। তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমের খবর বলছে, ফাহিমের মোটা অঙ্কের অর্থ (৪ লাখ ডলার) সরিয়ে ফেলেছিলেন হ্যাসপিল। বিষয়টি ধরা পড়ার পর ফাহিম ওই অর্থ পরিশোধ করার সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু হ্যাসপিল এরপরও অর্থ চুরি করছিলেন ও আইনগত পদক্ষেপের সম্মুখীন হওয়ার হুমকি পান।
ফাহিমকেও এমপি আনারের মতো ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনামাফিক খুন করা হয়। প্রথমে তাকে অজ্ঞান করা হয়। হত্যার পর তার শরীর খণ্ডবিখণ্ড করা হয়। অর্থাৎ খুনের ধরন ও পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রে যেরকম, ভারত ও বাংলাদেশেও সেরকম। কেননা টাকার ‘গন্ধ’ ও মোহ সারা পৃথিবীতেই একই রকম। যে টাকার কারণে বন্ধুর হাতে বন্ধু, সন্তানের হাতে বাবা, ভাইয়ের হাতে ভাইও খুন হয়ে যান।
এমপি আনারের খুনের মধ্য দিয়ে আরেকটি মৌলিক প্রশ্ন সামনে আসছে যে, মৃত্যুর পরে তার বিরুদ্ধে এখন যেসব অভিযোগ জানা যাচ্ছে, সেগুলো কি সরকার বা তিনি যে দলের এমপি ছিলেন, সেই দল জানতো না? যদি জেনে থাকে তাহলে এরকম একজন অপরাধী কী করে দলের মনোনয়ন পেলেন? তার এলাকার মানুষ কি জানতো যে তিনি কত ধরনের অবৈধ কাজের সঙ্গে যুক্ত? যদি জেনে থাকে তাহলে মানুষ তাকে কেন ভোট দিয়েছে? নাকি মানুষ এটা দেখেছে যে, তিনি যেভাবেই পয়সা উপার্জন করুন না কেন, এলাকার গরিব দুঃখী মানুষকে তো সহায়তা করছেন। এলাকার রাস্তা সেতু কালভার্ট বানাচ্ছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করছেন। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অনুদান দিচ্ছেন। অতএব তার সমস্ত অপরাধ মাফ। অতএব তিনি কী উপায়ে টাকা উপার্জন করলেন সেটি নিয়ে ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশের জনপ্রতিনিধিদের ক্ষেত্রে নাগরিকদের এই বোধটিই কি এখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে? সৎ মানুষদের বিপরীতে পয়সাওয়ালা, দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের জনপ্রতিনিধি হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে নাগরিকদের এই নির্লিপ্ততা, অপরাধীদের ব্যাপারে দলের সহনশীলতা ও প্রশ্রয় কি প্রধান কারণ?
স্মরণ করা যেতে পারে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লক্ষ্মীপুর থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য শহিদ ইসলাম ওরফে পাপুলের পদ শূন্য ঘোষণা করা হয়। কারণ নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে কুয়েতের ফৌজদারি আদালত তাকে চার বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। ২০২০ সালের জুন মাসে মানব পাচার ও অর্থ পাচারের অভিযোগে কুয়েতে গ্রেফতার হন পাপুল। তখন তাকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়। এরপর ঘুষ লেনদেনের মামলায় চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১৯ লাখ কুয়েতি দিনার বা ৫৩ কোটি ১৯ লাখ ৬২ হাজার টাকা জরিমানা করেন দেশটির আদালত। বাংলাদেশের ইতিহাসে বিদেশের মাটিতে কোনও সংসদ সদস্যের ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম।
বাস্তবতা হলো- পাপুল ধরা পড়েছেন ও কুয়েতের বিচারব্যবস্থায় প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি বলে নিজেকে শাস্তির হাত থেকে বাঁচাতে পারেননি। দেশের আদালতে তার বিচার হলে সেই বিচারপ্রক্রিয়া কতটুকু প্রভাবমুক্ত থাকত, সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, টাকা ও রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বারা যে দেশের বিচারব্যবস্থা প্রভাবিত হয়, সেটি নতুন কোনও বিষয় নয়। বিশেষ করে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা ও শাস্তি নিশ্চিত করা খুব সহজ নয়। বরং নির্বাচন করতে অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার পরও, আদালতের রায় নিয়ে এসে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার উদাহরণও আছে। একইভাবে অসংখ্য এমপি, মেয়র ও চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে টাকা উপার্জনসহ নানাবিধ নৈতিক স্খলনের নানাবিধ অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা বারবার দলের মনোনয়ন পান এমনকি জনগণও তাদেরকে ভোট দেয়।
রাজনৈতিক দলগুলো এইসব টাকাওয়ালাকে মনোনয়ন দেয় নানা কারণে। প্রথম কারণ দল চালাতে অনেক টাকা লাগে। দলীয় ও নির্বাচনি ফান্ড তৈরি হয় টাকাওয়ালাদের পয়সায়। দ্বিতীয়ত, টাকাওয়ালা প্রার্থীদের কারণে দলের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়। সৎ ও ভালো মানুষ কিন্তু টাকা নেই—এরকম প্রার্থীরা মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদেরও পছন্দ নয়। কেননা এই ধরনের প্রার্থীরা নেতাকর্মীদের পেছনে অনেক টাকা খরচ করতে পারেন না। আবার দলও মনে করে যে, টাকা থাকলে তিনি ভোট কিনে এবং নির্বাচনি ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত নানা বিষয়কে ম্যানেজ করে সহজেই জয়ী হয়ে আসতে পারবেন—যা টাকা না থাকা প্রার্থীর পক্ষে কঠিন।
ফলে এমন নয় যে, দল মনোনয়ন দিলেও জনগণ তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করছে। অর্থাৎ একটি দুর্নীতিগ্রস্ত অর্থনীতি শুধু যে দেশের রাজনীতিকেই দূষিত করেছে তা নয় বরং সাধারণ মানুষের মনোজগতেও বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়েছে। একজন অপরাধী কিংবা অবৈধ পথে টাকা উপার্জনকারী কিংবা রাষ্ট্র ও জনগণের টাকা লুটপাটকারীও এখন ভোটে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন, আবার সেই জনগণই তাদেরকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করে আনছেন। অর্থাৎ টাকার কাছে রাজনীতি হেরে যায়। এমনকি মানুষও। এ এক বিরাট অসুখ। জীবনানন্দের ভাষায়: ‘পৃথিবীর গভীর, গভীরতর অসুখ এখন; মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীর কাছে।’
লেখক: সাংবাদিক
(প্রকাশিত লেখাটির মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে কোন আইনগত ও অন্য কোন ধরনের দায়-ভার মিরর টাইমস্ বিডি বহন করবে না)।