রেজানুর রহমান : খবরটা পড়ে একটু অবাকই হলাম। দেশের কোথাও কোথাও নাকি ওজন নির্ধারণ করে কোরবানির পশুর দাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ আস্ত একটা গরুকে লম্বালম্বি ফিতা দিয়ে মেপে ওজন নির্ধারণ করার পর কেজি হিসেবে দাম হাঁকা হয়েছে। আবার এমন খবরও পড়েছি, দেশের একটি পশুর হাটে কোরবানির একটি গরুর দাম হাঁকা হয়েছে এক কোটি টাকা। অবিশ্বাস্য খবর!
গরুটি শেষ পর্যন্ত কত টাকায় বিক্রি হয়েছে তা জানতে পারিনি। তবে গরু বিক্রেতার সাহস দেখে অবাক হয়েছি। একটি গরুর দাম এক কোটি টাকা চাওয়া সত্যি সাহসের ব্যাপার। এ ধরনের খবর পড়লে সহজেই একটি ধারণা পোক্ত হয়। সেটা হলো দেশের মানুষের টাকার অভাব নেই। সত্যি কি তাই? এই বিশ্লেষণে যাবো না।
আজ পবিত্র ঈদের দিন। ঈদুল আজহা। এক কথায় আজ কোরবানির ঈদ। ত্যাগের মহিমায় নিজেকে, নিজেদের আলোকিত করার দিন। ঈদুল আজহার আজকের দিনটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ঈদ মানেই উৎসব। ঈদ মানেই আনন্দ। টি-২০ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য লড়াই করছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। আজ সকালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাঠে নেপালের সঙ্গে লড়াই করে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল জয় পেয়েছে। বাংলাদেশের এই জয়ে টি-২০ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সুপার এইট পর্বে উঠে গেছে বাংলাদেশ। পবিত্র ঈদের দিনে এর চেয়ে আনন্দের খবর আর কিছু হতে পারে না।
এ কথা তো সত্য, ক্রিকেট হাসলেই গোটা বাংলাদেশ হাসে। ঈদের দিনে ক্রিকেটের এই জয় সারা দেশে আনন্দ উৎসবের মাত্রা বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। আনন্দে হাসছে গোটা দেশের মানুষ।
ঈদ আমাদের দেশে প্রধান ধর্মীয় উৎসব। বছরে দুটি ঈদ। ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা। ঈদুল ফিতরকে আমরা আদর করে বলি পবিত্র রমজানের ঈদ। ঈদুল আজহাকে বলি কোরবানির ঈদ। ঈদুল ফিতরে এক মাসের রোজা আর নতুন পোশাক কেনার ব্যস্ততা থাকে। ঈদুল আজহায় পশু কোরবানির ব্যস্ততা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। রোজা রাখা ফরজ। কিন্তু আমরা অনেকেই পবিত্র রমজানে রোজা রাখি না। তবে ইফতারিতে অনেক খাবার অপচয় করি। রোজা রাখার চেয়ে ইফতারিই যেন মুখ্য বিষয়। তেমনই ঈদুল আজহায় কোরবানির নিয়ম ও তাৎপর্যকে গুরুত্ব না দিয়ে কে কত বড় সাইজের গরু কিনতে পারি তার প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে উঠি। ধর্মীয় বিধানে যারা সামর্থ্যবান শুধু তাদেরই পশু কোরবানি দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবকে গুরুত্ব দিয়ে পাশের বাড়ির কোরবানির গরুর চেয়ে আরও বড় গরু কেনার মানসিকতা পরিহার করতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা ধর্মীয় বিধান মেনে কতজন কোরবানি দেই, এ ব্যাপারে বিতর্ক হতে পারে।
ছোটবেলায় দেখেছি ধর্মীয় বিধান মেনেই কোরবানির গরু কেনা ও জবাই করার ব্যাপারেই সবাই তৎপর থাকতেন। নিজেরা হাটে গিয়ে গরু, ছাগল কিনতেন। বাড়িতে এনে পরিবারের আপন সদস্যের মতো আদর-যত্নে খাবার খাওয়াতেন। নিয়মিত গোসল করিয়ে দিতেন। এর ফলে কোরবানির পশুটির প্রতি সবার মায়া পড়ে যেত। ধর্মীয় বিধানে কোরবানির পশুর প্রতি এই মায়া সৃষ্টির কথা জোর দিয়ে বলা হয়েছে। অথচ ইদানীং পশুর প্রতি মায়া সৃষ্টির সেই উদ্যোগ তেমন চোখে পড়ে না। পড়বে কী করে? অনেকেই তো এখন গরুর হাটে গিয়ে কোরবানির গরু কিনেন না। হাটে যাবার দরকারও পড়ে না। অনলাইনে গরু কেনা যায়। আবার অনলাইনে যে প্রতিষ্ঠান গরু বিক্রি করে তারা ঈদের দিন কোরবানির গরু জবাই করে, মাংস কেটে ক্রেতার বাড়ির ঠিকানায় মাংস পাঠিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও নেয়। এই প্রক্রিয়ায় অনেকেই পশু কোরবানি দিচ্ছেন। মোবাইলে পাঠানো গরু, ছাগলের ছবি দেখে দাম দর ঠিক করে নিচ্ছেন। গরু অথবা ছাগলটিকে সরাসরি দেখার প্রয়োজনও মনে করেন না অনেকে। তার সময় কোথায়? টাকা আছে, দিলাম পশু কোরবানি। পাশের বাড়ির গরুর চেয়ে নিজের গরুটা যেন মোটা তাজা হয়। দাম কোনও ফ্যাক্টর নয়।
ধর্মীয় বিধানে আছে, কোরবানির পশু জবাই করার পর মাংস কেটে সমান ৩ ভাগ করতে হবে। এক ভাগ নিজেদের জন্য রেখে বাকি দুই ভাগের এক ভাগ পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে, অন্য ভাগ ফকির, মিসকিন অর্থাৎ অসহায় দুস্থ মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হবে। আমরা যারা পশু কোরবানি দেই তারা কতজন এই বিধান মেনে চলি?
ঈদ উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর দেশে কিছু না কিছু পরিবর্তন ঘটে যায়। শহরের মানুষ গ্রাম চলে যান। একে বলে নাড়ির টান। অতীতকালে কী হতো? নাড়ির টানে ঘরে ফেরা মানুষগুলো গ্রামে ফিরে গিয়ে পাড়া প্রতিবেশীর সঙ্গে তো বটেই, দূরের কোনও আত্মীয়ের সঙ্গেও দেখা করতো। কুশল বিনিময় করতো। আর এখন? গ্রামে ফিরে অনেকেই পাড়া প্রতিবেশীর সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন অনুভব করেন না। মোবাইল ফোনে সময় কাটান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢুকে ভুলে যান প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগের কথা। বলতে গেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই বদলে দিয়েছে ঈদ উৎসবের আমেজ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক অর্থে আশীর্বাদও বটে। এর অনেক ভালো দিক রয়েছে। কিন্তু আমরা অনেকে ভালোকে গুরুত্ব না দিয়ে কালো অর্থাৎ অন্ধকারকেই গুরুত্ব দিচ্ছি।
ঈদের নামাজ শেষে পরিচিত অপরিচিত সবার সঙ্গেই কোলাকুলি করার ধর্মীয় বিধান আছে। কিন্তু আমরা কতজন এ ব্যাপারে আন্তরিকতা দেখাই। বরং অনেকে ঈদের নামাজ শেষে পাশের মুসল্লিকে ধাক্কা দিয়ে বাড়ির পথে রওনা দেন। ঈদ উৎসবের সঙ্গে এই মানসিকতা মানানসই নয়। অথচ আমরা অনেকেই তা করি। শহরে ফ্ল্যাট বাড়িগুলোতে ঈদের দিনেও মুখোমুখি ফ্ল্যাটের সদস্যদের মধ্যেও ঈদ মোবারক বলার আন্তরিকতা গুরুত্ব পায় না। বরং পরস্পরকে এড়িয়ে চলার প্রবণতাই বেশি। আমি তোমার সঙ্গে কম কীসে? তোমার সঙ্গে কী আমার যায়…? এমন মানসিকতার বলি হচ্ছে সামাজিক সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐক্য।
যারা আমার লেখাটি পড়ছেন তাদের প্রতি কয়েকটি অনুরোধ করতে চাই। নাড়ির টানে যারা বাড়ি ফিরেছেন তারা কি বাড়ির মানুষগুলোর অর্থাৎ বাবা-মা, ভাই-বোন, ভাবি, দাদা-দাদি, চাচা-চাচি তাদের সন্তানদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে দেখা করেছেন? কথা বলেছেন? দেখা হয়েছে কি প্রতিবেশীদের সঙ্গে? আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ নিয়েছেন কি? একই স্কুলে পড়তেন। ভাগ্যগুণে আপনি বিএ, এমএ পাস করে শহরে বড় চাকরি করেন, বড় ব্যবসায়ী হয়েছেন, মনে পড়ে কি স্কুলের সেই প্রিয় সহপাঠীর কথা? যিনি এখনও গ্রামেই রয়ে গেছেন? তার খোঁজ নিতে ভুলবেন না। আপনি যদি তার সঙ্গে দেখা করেন, বুকে জড়িয়ে ধরে শুধু জিজ্ঞেস করেন কেমন আছিস বন্ধু। দেখবেন ঈদের দিনের আনন্দটা আরও ঝলমলে হয়ে উঠবে।
আপনার দেওয়া কোরবানির পশুর মাংসে অসহায় দুস্থ মানুষদের একটা হক আছে। পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনেরও একটা হক আছে। এই হক থেকে তাদের বঞ্চিত করবেন না।
ঈদ উৎসবে আনন্দের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে ওঠে টেলিভিশন অনুষ্ঠান। প্রতি বছরের মতো এবারও দেশের প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেল ৭ দিনব্যাপী ঈদের ব্যাপক অনুষ্ঠানমালা সাজিয়েছে। এবারের ঈদে দেশের সব টিভি চ্যানেল মিলিয়ে দুই শতাধিক নতুন নাটক, টেলিফিল্ম প্রচার হবে। আছে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান। নতুন সিনেমার প্রদর্শনী। একটাই অনুরোধ, দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর এত আয়োজনকে গুরুত্ব দিন। ঈদের ৭ দিন আমরা কী বিদেশি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখার ক্ষেত্রে বিরতি দিতে পারি? আসুন না সবাই মিলে দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ঈদ অনুষ্ঠানের প্রতি নজর দেই।
এই ঈদ উৎসবে আপনার প্রতিবেশী কেমন আছে খোঁজ নিয়েছেন কি? প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে আনন্দ করবেন না। দুস্থ গরিব অসহায় প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়ান। তাহলেই ঈদ উৎসবের সার্থকতা ফুটে উঠবে।
শেষে ছোট্ট একটি প্রস্তাব করতে চাই। ঈদে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরেছেন, গ্রামের দুস্থ, অসহায়, মেধাবী কোনও ছাত্রছাত্রীর পাশে দাঁড়াতে পারেন। আপনার সামর্থ্য থাকলে গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীকে এককালীন কিছু অর্থ সহায়তা দিতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনার আন্তরিকতাই যথেষ্ট। পাঠক, অনেক শুভকামনা সবার জন্য। পবিত্র ঈদের শুভেচ্ছা নিন। ঈদ মোবারক।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক: আনন্দ আলো।