ঢাকা : সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় দুই সংসদ সদস্য। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না হলেও রাজনীতিবিদদের দুর্নীতির দায় নিতে হচ্ছে। তারা বলেন, আমরা সব পলিটিশিয়ানরা নাকি দুর্নীতি করি। আর উনারা (আমলারা) অন্য কিছু করে না। বাড়ি-গাড়ি করে দেশে-বিদেশে, বেগমপাড়ায়, আর কোন কোন পাড়ায় বাড়ি করে, সুইস ব্যাংকে টাকা রাখে। আজকে দোষ কিন্তু পলিটিশিয়ানদের।
মঙ্গলবার (২৫ জুন) ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া-২ আসনের এমপি মাহবুব উল আলম হানিফ ও লালমনিরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন এ অভিযোগ করেন।
মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, দুর্নীতি সরকারের সব অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে। জিরো টলারেন্স নীতির পরেও দুর্নীতি দমন করতে পারেনি বা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। আজকে বাজারে অস্থিতিশীলতা দেখা যায়, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়। বাজারে দুর্নীতির অবাধ প্রবাহ থাকলে সেটি কখনও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
তিনি বলেন, এবার দুটি ঘটনা সারা দেশে আলোচিত হয়েছে। একটা গরু এক কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে। এটা কারা কিনলো? কেন কিনলো? বৈধ আয়ে এটা কিনতে পারে না। অবৈধ উপায়ে যাদের আয়—তারা খামখেয়ালিভাবে এভাবে কিনতে পারে। একটা ছাগল কিনলো ১৫ লাখ টাকা দিয়ে। এটা কারা করতে পারে? যাদের অবৈধ আয় আছে তারা। বৈধ আয়ে কখনও টাকা পানিতে ফেলতে পারে না। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে দুর্নীতিটাকে আগে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।
হানিফ বলেন, সরকারি কর্মচারীদের দফায় দফায় বেতন বাড়ানো হয়েছে। তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। তারপরও কেন দুর্নীতি হবে? আজকে দুর্নীতির কথা উঠলে সকলে প্রথমে আঙুল দেখায় রাজনীতিবিদদের দিকে। রাজনীতিবিদরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। এটা দেশে প্রচলন আছে। অথচ সংসদ সদস্যদের মধ্যে মন্ত্রী ছাড়া কারও নির্বাহী ক্ষমতা নেই। তারা কীভাবে দুর্নীতি করবে? দুর্নীতি হয় সরকারের উন্নয়ন ও কেনাকাটায়। সেখানে একজন রাজনীতিবিদের সুযোগ কোথায়, যদি সরকারি কর্মকর্তারা তার সঙ্গে জড়িত না থাকে। ২০১৮ সালে জনপ্রশাসনে তথ্য এসেছিল, এক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ জমা আছে। এরকম হাজার হাজার মতিউর আছেন। দফায় দফায় বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে। তারপরও দুর্নীতি কমানো সম্ভব হয়নি। দুর্নীতির বিধিবিধানকে বরং আরও নমনীয় ও শিথিল করে দেওয়া হয়েছে। নামমাত্র দণ্ড দিয়ে তাদের চাকরিতে বহাল রাখার সুযোগ রাখা হয়েছে।
হানিফ বলেন, জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হলে তাদের গ্রেফতারে অনুমতি নেওয়া লাগে না। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে একই ধরনের মামলা হলে তাকে গ্রেফতারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি নিতে হয়। সরকারি কর্মচারী আইন-২০১৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি করতে উৎসাহিত করেছে। সরকারি চাকরিজীবীরা ১ বছরের কম শাস্তি পেলে চাকরি থেকে অব্যাহতি পাবেন না। তাকে তিরস্কার, বিভাগীয় শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, যা সুশাসনের সহায়ক না। অথচ স্থানীয় প্রতিনিধিদের এরাই তাৎক্ষণিক বরখাস্ত করার ক্ষমতা রাখে। এই আইনের কারণে দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের আইনের আওতায় আনতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এটা কার্যত অপরাধী সুরক্ষা আইন হিসাবে বিবেচিত। তিনি আইনটি পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ করেন।
হানিফ বলেন, দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে প্রথমে ভোগের রাস্তা বন্ধ করতে হবে। যারা জমি, বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট রেজিস্ট্রি করেছেন, প্রতি মাস শেষে তাদের তালিকা নিয়ে বিশেষ টিম পাঠিয়ে আয়ের বৈধ উৎস জানার কৈফিয়ত চাওয়া হোক। একইভাবে গাড়ি ও স্বর্ণালংকারের দোকান থেকে তালিকা নিয়ে বৈধ আয়ের উৎস জানতে চাওয়া হোক। আমার বিশ্বাস তাহলে অবৈধ আয়কারীদের ভোগ-বিলাস বন্ধ হবে।
তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে আমাদের হলফনামা দিতে হয়, সব সম্পদের বিবরণ দিতে হয়। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তাদের হলফনামা দিতে হয় না। আমার প্রস্তাব থাকবে চাকরিতে নিয়োগের সময় হলফনামা বাধ্যতামূলক এবং প্রতি পাঁচ বছর পর বা পদোন্নতির সময় হলফনামা দিতে হবে। যাতে তার সম্পত্তির পরিমাণ জাতি জানতে পারে।
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে প্রয়োজন ছিল সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি। বাজেটে এর প্রতিফলন দেখেছি। উন্নয়ন ঋণ বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণভাবে ধার্য করা হয়েছে। এতে ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে দেশে ব্যাংক ঋণ বেড়েছে। কিন্তু বৈশ্বিক ও আন্তর্জাতিকভাবেও ঋণের সুদের হার বেড়েছে। চড়া সুদে ঋণ নিয়ে যদি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করতে হয় তাহলে অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি হবে।
১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগের বিরোধিতা করে হানিফ বলেন, আমি বৈধভাবে আয় করলে ৩০ শতাংশ কর দিতে হয়, আরেকজন অবৈধ, অপ্রদর্শিত আয় করে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করবে এটাকে যৌক্তিক মনে করি না। এতে অনেকেই ট্যাক্স দিতে অনীহা প্রকাশ করবে। তারা ভাববে এই বছর অপ্রদর্শিত রেখে আগামী বছর ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করবো। সে কারণে এক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগ দেওয়ার দাবি করেন তিনি।
তিনি বলেন, আমরা দেখি দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়। যার ফলে সাধারণ মানুষের মাঝে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে তা করতে হয়। কিন্তু বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম সহনীয় পর্যায়ে আছে।
লালমনিরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন বলেন, আজকে আমরা ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আছি। আমি ১৯৮৫ সালে যখন উপজেলা চেয়ারম্যান হই তখন হাতিবান্ধায় ১০টি ইউনিয়ন ছিল। ১৯৮৭ সালে সার্ভে করে হিসাব করলাম ইউনিয়নগুলোর পাকাবাড়িগুলো কাদের। দেখলাম ৯২ শতাংশ বাড়ি হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তাদের। এখন তো আর বলাই যাবে না। এত বাড়ি, এত জমি, এত ঘরবাড়ি হলো—আমাদের এত ইন্টেলিজেন্স কেউই টের পেলো না। রক্ষক ভক্ষক হলে যা হয়। সেটাই হয়েছে। এদের হাতেই সব কিছু। আমাদের টিআর-কাবিখার বরাদ্দ এখন ডিসি সাহেবকে দেওয়া হয়, বিভাগীয় কমিশনারদের দেওয়া হয়, ইউএনওকেও দেওয়া হয়— আমরা কারা? আমাদের গুরুত্ব তো এভাবেই কমে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, আমি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে থাকতে নিয়োগ কমিটিতে জেলা প্রেসিডেন্ট বা সাধারণ সম্পাদককে সদস্য রেখেছিলাম। তিন বছর আগে সেটাও তুলে দেওয়া হয়েছে। সব পলিটিশিয়ানরা নাকি দুর্নীতি করে। আর উনারা সব কিছু ঠিক করেন, অন্য কিছু করেন না। বাড়ি-গাড়ি করে দেশে-বিদেশে, বেগমপাড়ায়, আর কোন কোন পাড়ায় বাড়ি করে, সুইস ব্যাংকে টাকা রাখে— আজকে দোষ কিন্তু আমাদেরই, পলিটিশিয়ানদের। আমাদের পেছনে-সামনে তো এত লোক লাগানো আছে। সাংবাদিক ভাইয়েরা তো আছেনই। একটি বেফাঁস কথা বললেই…। তারপর আমরা পলিটিশিয়ানরা। আমার বিরুদ্ধে যারা ভোট করেন, এত প্রতিকূল অবস্থায়… ৫০ বছর ধরে আমরা ভোট করছি। প্রত্যেকটা ভোটে আমাদের জবাবদিহি করতে হয়। কোথায় ভুল করেছি। কোথায় কী হয়েছে।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা রাজনীতিবিদরা আনক্লাসিফাইড হয়ে যাচ্ছি। রাজনীতি না থাকলে দেশের উন্নয়ন হবে না। মানুষের মঙ্গল করা যাবে না। আমরা তো পেছনে পড়ে গেছি। বরাদ্দের জন্য মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে বলেন সচিব সাহেবদের সঙ্গে কথা বলেন। আমরা তো মারাত্মক অবস্থায় পড়ে গেছি। এই জায়গা থেকে উত্তরণের ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে।
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনকে ইঙ্গিত করে মোতাহার হোসেন বলেন, ‘ব্যারিস্টার সাহেব বলে ফেলছেন। ফেসবুকে দিয়ে দিয়েছেন। উনি নাকি ২৮ কোটি টাকা পেয়েছেন। উনি এই টাকা পেলো কোথায়, রাখলো কোথায়? কোন ব্যাংকে রেখেছেন—এ হিসাবটি কি উনি দিতে পারবেন? ২৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে ৫ বছরের উন্নয়ন কাজের জন্য। মানে বছরে ৫ কিলোমিটার করে রাস্তা আমরা করতে পারবো। সেটা আবার আমরা দেবো প্রস্তাব। এলজিইডি সার্ভে করবে, টেন্ডারও করবে তারা, ওয়ার্ক অর্ডারও দেবে তারা। তাহলে আমরা কোথায় টাকা পেলাম।
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য একরামুজ্জামান বলেন, এর আগেও কালো বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছিল। কিন্তু তাতে আশানুরূপ ফল দেখা যায়নি। তিনি শেয়ারবাজার ও শিল্পে কালোটাকা বিনিয়োগ করার সুযোগ দেওয়ার দাবি করেন।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ বলেন, মূল্যস্ফীতি সামনে আরও বাড়তে পারে। প্রবাসী আয় বাড়ছে না। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে না। তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে অন্যতম সমস্যা খেলাপি ঋণ। এখন এই ঋণ প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। এই টাকা পাচার হচ্ছে। তারল্য সংকট কাটিয়ে ব্যাংক খাত কীভাবে ঠিক করা যায় তা দেখতে হবে। ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।