১৯৯৫ সালে সংঘটিত স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে ১১ জুলাইকে সেব্রেনিৎসা গণহত্যা স্মরণ দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ভোটাভুটির মধ্য দিয়ে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এই প্রস্তাবকে ‘পলিটিসাইজড’ বলে আখ্যা দেন সার্ব রাষ্ট্রপতি আলেকজান্ডার ভুসিক। তার দাবি, এর ফলে পুরো সার্বিয়া এবং সার্ব জনগণের গণহত্যাকারী হিসেবে পরিচিতি তৈরি হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হলো।
বসনিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় স্রেব্রেনিৎসায় জাতিসংঘ ঘোষিত ‘সেইফ এরিয়া’ (নিরাপদ স্থান) শান্তিরক্ষীদের তত্ত্বাবধানে ছিল। কিন্তু, সংখ্যায় অপ্রতুল হওয়ায় শান্তিরক্ষীরা বসনিয়ান-সার্ব বাহিনীর সঙ্গে পেরে ওঠেনি।
হত্যায়ই থেমে থাকেনি নৃশংসতা। পরবর্তী সময়টা জুড়ে বসনিয়ান-সার্ব বাহিনীর সদস্যরা নিহতদের গণকবরগুলো পুনরায় খোঁড়ে। গণহত্যাকে ধামাচাপা দিতে দেহাবশেষগুলোকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয় তারা।
ফলে, একেকজনের শরীরের অংশগুলো বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে পড়ে। ভুক্তভোগীদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায়। ঘটনার ২৯ বছরে বেশিরভাগ পরিবার কিছু না কিছু দেহাবশেষ শনাক্ত করে দাফন করতে সক্ষম হয়েছে। গণহত্যার স্থানটির কাছেই, পোতোক্যারি সিমেট্রিতে কবর দেওয়া হয়েছে তাদের।
তবে, কোনো কোনো পরিবারকে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
দ্য ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন মিসিং পারসনস্ এর সহায়তায় ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে সাত হাজার ভুক্তভোগীকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে একটি বিবৃতি দিয়েছে সংস্থাটি।
দিবসটি ব্যক্তি, পরিবার এবং সম্প্রদায়ের ওপর গণহত্যার স্থায়ী ক্ষতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যার শিকার মানুষগুলোকে স্বীকৃতি এবং শ্রদ্ধা জানানোর ক্ষেত্রে মাইলফলক হয়ে থাকবে।’
অবশ্য, সার্বিয়া সরকার বিষয়টিকে একইভাবে দেখছে না। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আলোচনার সময় দেশটির প্রেসিডেন্ট ভুসিক হুঁশিয়ার করে বলেন, এই প্রস্তাব পাস হলে তা ‘প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিতে পারে’।
আরও অনেক গণহত্যা নিয়েই তখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ক্রোয়েশিয়ায় নাৎসি বাহিনীর মিত্র সরকারের শাসনামলে সার্বরা গণহত্যার শিকার হয়েছিল উল্লেখ করে, তার জন্য জাতিসংঘে যে কখনও কোনও প্রস্তাব পাস হয়নি তা মনে করিয়ে দেন ভুসিক।
ওই ঘটনার জন্য সার্বিয়াও এমন একটি গণহত্যার প্রস্তাব নিয়ে আসতে পারতো বলে মন্তব্য করেন তিনি। ভুসিক দাবি করেন, ‘স্রেব্রেনিৎসা প্রস্তাবে কোনো সমাধানের ব্যাপার নেই, স্মৃতির ব্যাপার নেই বরং এতে নতুন ক্ষত সৃষ্টি হবে, শুধু আমাদের আঞ্চলিক পর্যায়ে নয়, এই পরিষদেও।’
সার্বিয়া সরকারের এমন তীব্র বিরোধিতায় সেই দেশটিতেও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। কারণ, প্রস্তাবে সুনির্দিষ্টভাবে কেবল গণহত্যায় দায়ী ব্যক্তিদের কথাই বলা হয়েছে। স্পষ্ট করা হয়েছে, সেই দায় ‘নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয় বা অন্য কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের ওপর সামগ্রিকভাবে আরোপ করা যাবে না’।
স্রেব্রেনিৎসায় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এমন রুল জারি করলেও, দেখতে পেয়েছে সার্বিয়া এর জন্য সরাসরি দায়ী বা সম্পৃক্ত নয়। অবশ্য, সার্বিয়া গণহত্যা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন বিচারকরা।
তিন বছর পর, সার্বিয়ার জাতীয় সংসদে গণহত্যার নিন্দা জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস হয়। প্রতিরোধে আরও ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য ক্ষমাও চাওয়া হয় সেই প্রস্তাবে। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় আলেকজান্ডার ভুসিক হত্যাকাণ্ডের ২০ বছর পূর্তিতে স্রেব্রেনিৎসায় শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন।
বিক্ষুব্ধদের কেউ কেউ তার দিকে বোতল এবং পাথর ছুঁড়ে মারে। কিন্তু তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ‘তিনি ক্ষতিপূরণের নীতিতে অটল থাকবেন’।
অবশ্য, সার্ব জাতীয়তাবাদীদের অনেকে গণহত্যার হোতা ম্লাদিচকে একটা নায়কোচিত চরিত্র হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে থাকেন। যেমন, বসনিয়ার সার্ব অধ্যুষিত রিপাবলিকা স্রপস্কা প্রদেশের প্রেসিডেন্ট মিলোরাদ দদিক ক্রমাগতভাবে স্রেব্রেনিৎসায় গণহত্যার কথা নাকচ করে আসছেন। যদিও, দেশটির আইনে গণহত্যা অস্বীকারকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। বিবিসি বাংলা