১৩ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৯শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Mirror Times BD

এমপি আনারকে কলকাতায় ডেকে নেন বন্ধু শাহীনই

মিরর ডেস্ক : ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার পরিবারের কাছে বলে গিয়েছিলেন, চিকিৎসার জন্য কলকাতা যাচ্ছেন। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জানিয়েছেন, আনার কলকাতায় গিয়েছিলেন তার পুরোনো বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আক্তারুজ্জামান শাহীনের আহ্বানে। কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জীবনী গার্ডেনের যে ফ্ল্যাটে হত্যাকাণ্ড ঘটে, সেখানেই ব্যবসায়িক বৈঠক হওয়ার কথা ছিল তাদের।

ওই বৈঠকে যোগ দিতে ১২ মে দর্শনা স্থলবন্দর হয়ে কলকাতায় যান এমপি আনার। এদিকে তাকে হত্যার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে এর দুদিন আগেই শাহীন দেশে ফিরে আসেন। তিনি যে দেশে ফিরে এসেছেন, তা এমপি আনারের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, স্বর্ণ চোরাচালানের ২০০ কোটি টাকা নিয়ে শাহীন ও আনারের দ্বন্দ্ব ছিল। এই দ্বন্দ্ব থেকেই তিন মাস ধরে এমপি আনারকে হত্যার ছক আঁকা হয়। ছক অনুযায়ী আনারকে ব্যবসায়িক মিটিংয়ের কথা বলে ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে হত্যা করা হয়। তবে আনারকে ফ্ল্যাটে নেওয়ার জন্য কোনো নারীকে দিয়ে ‘হানি ট্র্যাপ’ পাতা হয়েছিল কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এমপি আনার হত্যার খবরটি প্রকাশ হওয়ার আগেই দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান শাহীন। তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব না হলেও হত্যার সঙ্গে জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। গ্রেপ্তাররা হলেন শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহ সাইদ, তানভীর ভূঁইয়া ও শিলাস্তি রহমান। ডিবি জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৫ মিনিটে শিমুল ও তানভীরকে সাভারের লুটেরচর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের দেওয়া তথ্যে দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিটে উত্তরা থেকে শিলাস্তি রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল শুক্রবার তাদের ঢাকা মহানগর আদালতে হাজির করা হলে প্রত্যেকের ৮ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন বিচারক। হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছে ডিবি। আনার হত্যার সঙ্গে শাহীনের পাশাপাশি আরও কয়েকজন জড়িত থাকার ব্যাপারে সন্দেহ করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এই তালিকায় সাবেক একজন সংসদ সদস্য, বড় একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর নামও রয়েছে। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, এমপি আনারের প্রভাবে সন্দেহভাজন এই ব্যক্তিরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন।

এদিকে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত জিহাদ হাওলাদার নামে এক কসাইকে গ্রেপ্তার করেছে কলকাতা সিআইডি। তাকে ১২ দিন হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বারাসাতের আদালত। ভারতের মুম্বাই থেকে এই বাংলাদেশি কসাইকে গ্রেপ্তার করা হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি ওয়ারী বিভাগের সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান জানান, আনারের সঙ্গে শাহীনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। ব্যবসায়িক লেনদেনসহ কিছু বিষয় নিয়ে আনারের ওপর শাহীনের ক্ষোভ ছিল। এ ছাড়া গ্রেপ্তার মূল ঘাতক শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে আনারের মতাদর্শের দ্বন্দ্ব ছিল। শিমুল ছিলেন এক সময়ে খুলনার শীর্ষ চরমপন্থি নেতা। শাহীন ও শিমুল মিলে আনারকে কলকাতায় নিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করেন। শাহীন অন্যদের নিয়ে ৩০ এপ্রিল থেকে কলকাতার নিউটাউনের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন।

ডিবির এই কর্মকর্তা জানান, পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১০ মে দেশে ফিরে আসেন শাহীন, যা এমপি আনার জানতেন না। আসার সময় শাহীন পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী শিমুল ভূঁইয়াকে দায়িত্ব দেন—কোনোভাবেই যেন কাজটা মিস না হয় এবং কোনো প্রমাণ না থাকে। ১২ তারিখ কলকাতায় যাওয়ার পর গোপাল নামে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ী বন্ধুর বাসায় ছিলেন আনার। পরদিন শাহীনের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে যান এমপি। সেখানেই শিমুল, তানভীর, শিলাস্তিসহ অন্যরা মিলে এমপি আনারকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। হত্যার পর লাশের মাংস ও হাড় আলাদা করে ট্রলি ব্যাগে ভরে বাসার বাইরে নিয়ে গুম করে ফেলে তারা।

কয়েকদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার খবর পরিবার থেকে জানানোর পর এমপি আনারের বন্ধু গোপাল ১৭ মে বরাহনগর থানায় জিডি করেন। এমপি আনারের পরিবার থেকেও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়। আনারের সন্ধান করতে গিয়ে ওই অভিজাত ফ্ল্যাটের সন্ধান পায় পুলিশ।

মরদেহের খণ্ডিত অংশ উদ্ধারে কলকাতা পুলিশ একের পর এক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার রাতেও কলকাতা ও উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার কিছু এলাকায় অভিযান চালানো হয়। কসাই জিহাদকে গ্রেপ্তারের পর লাশ উদ্ধারের এ অভিযান চালায় সিআইডি।

দুই মাস আগে জিহাদকে কলকাতায় নেন শাহীন

জিহাদ হাওলাদারকে গত বৃহস্পতিবার ভারতের মুম্বাই থেকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তার বাড়ি খুলনার দীঘলিয়ায়। পেশায় কসাই জিহাদকে দিই মাস আগে শাহীন কলকাতায় নিয়ে যান বলে জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি। এমপি আনারকে শ্বাসরোধে হত্যার পর তার মরদেহ গুম করার জন্য টুকরো করতে কসাই জিহাদকে ব্যবহার করে হত্যাকারীরা। শাহীনের নির্দেশে পাঁচজন মিলে আনারকে হত্যার বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির কাছে স্বীকার করেছেন জিহাদ।

সিআইডি জানিয়েছে, নিহত এমপি আনারের পরিচয় যাতে বোঝা না যায়, সেজন্য হত্যাকারীরা তার শরীরের হাড় ও মাংস আলাদা করে ফেলে। এরপর হাড় ও মাংস টুকরা টুকরা করে কেটে বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেয়।

এদিকে ঢাকায় গ্রেপ্তার তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে ডিবির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, এমপি আনারকে হত্যার পর মরদেহ কেটে টুকরো করার পাশাপাশি হাড় থেকে মাংস কেটে আলাদা করা হয়। এরপর মাংসের টুকরাগুলো কিমা করে টয়লেটে ফেলে ফ্লাশ টানা হয়। মাথার খুলি, হাড়সহ দেহের অন্যান্য অংশ ট্রলি ব্যাগে ভরে বাইরে ফেলে আসে খুনিরা।

খণ্ডিত অংশ উদ্ধারে দুদিন ধরে তল্লাশি

কসাই জিহাদকে মুম্বাই থেকে গ্রেপ্তারের পর মরদেহের খণ্ডিত অংশ উদ্ধারে বৃহস্পতিবার রাত থেকে অভিযান চালাচ্ছে ভারতের সিআইডি। ওইদিন রাতে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার ভাঙ্গর থানার জিরেনগাছা ব্রিজ এলাকায় তল্লাশি চালায় সিআইডি। তবে কোনো কিছু না পেয়ে রাতেই তল্লাশি শেষ করেন কর্মকর্তারা। গতকাল বিকালে ভাঙ্গরের কৃষ্ণ মাটি এলাকায় তল্লাশি চালানো হয়।

জলাশয়ের মধ্যে নেমে সিআইডি সদস্যদের তল্লাশি চালাতে দেখা যায়। তবে তিন ঘণ্টা তল্লাশি চালিয়েও মরদেহের কোনো অংশের খোঁজ পাওয়া যায়নি। সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, জিহাদ যে জায়গাকে চিহ্নিত করেছিল সেখানে কিছু পাওয়া যায়নি। সম্ভবত সে ইচ্ছে করেই ভুল জায়গা দেখিয়েছে। আজ শনিবারও তল্লাশি অব্যাহত থাকবে।

দুই ফুটেজে যা দেখা গেছে

নিউটাউনের সঞ্জিভা গার্ডেনের বেশ কিছু সিসি ক্যামেরার ফুটেজ হাতে পেয়েছেন গোয়েন্দারা। যেগুলোতে এমপি আনার ও তার সন্দেহভাজন খুনিদের গতিবিধি ধরা পড়েছে। ওই ফ্ল্যাটের সামনে স্থাপিত একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, ১৩ মে দুপুরে ২টা ৫৩ মিনিটের দিকে লিফট থেকে বের হয়ে ফ্ল্যাটের সামনে হাজির হন তিন ব্যক্তি। একজনের হাতে হলদে রংয়ের শপিং ব্যাগ। আরেকজনের কাঁধে ঝুলানো একটি সাইড ব্যাগ। তৃতীয় ব্যক্তির হাত খালি। কলিং বেল চাপলে ভেতর থেকে কেউ একজন দরজা খুলে দেন, একে একে তিনজন ভেতরে প্রবেশ করেন।

ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ডিবির তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছে, তিনজনের মধ্যে হাতে হলদে রঙের শপিং ব্যাগ থাকা ব্যক্তিটি সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার। কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো ব্যক্তি শিমুল ভূঁইয়া ও অন্যজন ফয়সাল।

আরেকটি সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, একই ফ্ল্যাট থেকে বের হচ্ছেন দুজন। তবে এবার তাদের সঙ্গে নেই সংসদ সদস্য আনার। তবে তাদের সঙ্গে আছে রহস্যজনক পেস্ট কালারের একটি লাগেজ। এই লাগেজটি নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে আসে একজন। অন্যজন বেশ কয়েকটি শপিং ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে আসেন। যিনি লাগেজটিকে নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি শিমুল ভূঁইয়া ও শপিং ব্যাগ হাতে ছিল ভারতীয় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার কসাই জাহিদ।

⠀শেয়ার করুন

loader-image
Dinājpur, BD
জানু ১৩, ২০২৫
temperature icon 20°C
clear sky
Humidity 41 %
Pressure 1014 mb
Wind 5 mph
Wind Gust Wind Gust: 5 mph
Clouds Clouds: 0%
Visibility Visibility: 10 km
Sunrise Sunrise: 06:53
Sunset Sunset: 17:34

⠀আরও দেখুন

Scroll to Top